গণতন্ত্র জিহাদ, না জিহাদের বদল?

“জিহাদ আল্লাহর হক এবং খালেস ইবাদাত” – শিরোনামে আলোচনা করেছিলাম যে, জিহাদ; নামায রোযার মতোই আল্লাহ তাআলার দেয়া এক মহান ইবাদাত। এটি আল্লাহ তাআলার হক। বান্দার কোনো দখল এতে নেই। পিতা মাতা সন্তানের উপর থেকে কিংবা রাষ্ট্র প্রধান জনগণের উপর থেকে এ জিহাদের দায়িত্ব রহিত করতে পারবে না, যেমন পারবে না নামায রোযা রহিত করতে।

বর্তমান সময়ে আমরা দেখছি গণতন্ত্রকে জিহাদ আখ্যা দেয়া হচ্ছে। যদি কেউ ধ্যান করাকে নামায আখ্যা দেয় তাহলে সবাই বলবে যে, এ লোক নামায রহিত করে দিচ্ছে। প্রকৃত নামাযকে রহিত করে ধ্যান নামক একটা কাজকে নামাযের স্থলাভিষিক্ত করছে। জিহাদের ক্ষেত্রেও কি বিষয়টা এমনই হচ্ছে না?

যদি দাবি সত্য হয় যে, গণতন্ত্র জিহাদ, তাহলে নিম্নের কোনো একটি মেনে নিতে হবে:
এক. দুনিয়াতে গণতন্ত্র চালু হওয়ার আগ পর্যন্ত জিহাদ ছিল কিতাল ফি সাবিলিল্লাহ এবং কিতাল সংক্রান্ত সহায়ক কার্যাবলী। গণতন্ত্র চালু হওয়ার পর শরীয়ত জিহাদের সে অর্থ বিলুপ্ত করে দিয়ে গণতন্ত্রকে জিহাদ বানিয়েছে। এতোদিন জিহাদ ছিল কিতাল ফি সাবিলিল্লাহ। বর্তমানে সেটি আর জিহাদ রয়নি (বরং তা সন্ত্রাসে পরিণত হয়েছে)। সেটির মেয়াদ শেষ। বর্তমানে জিহাদ হচ্ছে গণতন্ত্র।

দুই. জিহাদ একটি ব্যাপক বিষয়। তা শুধু কিতাল ও কিতাল সংক্রান্ত সহায়ক বিষয়াবলীর মাঝে সীমাবদ্ধ নয়। বরং জিহাদের মাঝে কিতাল ও গণতন্ত্র উভয়টিই শামিল ছিল। এতোদিন উম্মাহ কিতাল নামক জিহাদটি করেছে, বর্তমানে আমরা গণতন্ত্র নামের সেই মৃত জিহাদকে যিন্দা করছি, যা উম্মাহর সালাফে সালিহিন ও পরবর্তীরা করেনি।

তিন. কিংবা বলতে হবে: মূলত কিতাল ফি সাবিলিল্লাই জিহাদ। আর গণতন্ত্র হচ্ছে সেটির বদল। যেমন পবিত্রতা অর্জনের ক্ষেত্রে মূল বিধান হচ্ছে পানি ব্যবহার করে অজু বা গোসল করা। পানি না পাওয়া গেলে মাটি হবে তার বদল। মাটি দিয়ে তায়াম্মুম তখন পানি দিয়ে অজুর স্থলাভিষিক্ত হবে।

***
সামনের আলোচনায় যাওয়ার আগে দু’টি উসূল বুঝে নিলে সহজ হবে ইনশাআল্লাহ।
উসূল : শরীয়তের বিধানের ক্ষেত্রে শরীয়তের নির্দিষ্ট করে দেয়া অর্থ ও সূরতটিই ধর্তব্য। আভিধানিক অর্থের আশ্রয় নিয়ে তাতে ব্যাপকতা সৃষ্টি গ্রহণযোগ্য নয়। যেমন শরীয়তে সালাতের সুনির্দিষ্ট অর্থ ও সূরত রয়েছে। তাকবিরে তাহরিমা বলা থেকে নিয়ে কিরাত, রুকু, সাজদা ইত্যাদির সমন্বিত একটি সূরতের নাম হচ্ছে সালাত। সালাতের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে ‘দোয়া’। কেউ যদি বলে, শুধু বসে বসে দোয়া করার দ্বারাই সালাত নামক ফরযটি আদায় হয়ে যাবে, আমরা স্বাভাবিক যে সালাত পড়ি সেটি লাগবে না: কেউ সন্দেহ করবে না যে, লোকটি বেঈমান হয়ে গেছে।
এ উসূলটি শরীয়তের সব বিধানের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

উসূল: শরীয়তের বিধান দুই রকম: ক. আসল; খ. খালাফ তথা বদল। যেমন পানি ও অযু হচ্ছে পবিত্রতার ক্ষেত্রে আসল। আর বদল হচ্ছে মাটি ও তায়াম্মুম। শরীয়তের মূল বিধান যেমন শরীয়তের দলীল ছাড়া সাব্যস্ত হয় না, বদলও শরীয়তের দলীল ছাড়া সাব্যস্ত হয় না।

উসূলে বাযদাবির ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘কাশফুল আসরার’- এ শায়খ আব্দুল আজিজ বোখারি রহ. (৭৩০ হি.) বলেন,

الخلافة لا تثبت إلا بالنص أو دلالة النص لم يرد الشيخ الاقتصار عليهما بل يثبت بإشارة النص وباقتضائه أيضا وإنما أراد به انتفاء ثبوت الخلافة بالرأي يعني أن الخلف إنما يثبت بما يثبت به الأصل والأصل لا يثبت بالرأي فكذلك خلفه. –كشف الأسرار شرح أصول البزدوي (4/ 166) “(বাযদাবি রহ. বলেন,) ‘বদল ১- নস বা ২- দালালাতুন নস ছাড়া সাব্যস্ত হবে না।’ এ দু’টিতে সীমাবদ্ধ করা শায়খের উদ্দেশ্য না। বরং ৩- ইশারাতুন নস ও ৪- ইকতিজাউন নস দ্বারাও সাব্যস্ত হবে। শায়খের উদ্দেশ্য: বদল রায় (তথা আকল ও যুক্তি) দ্বারা সাব্যস্ত হবে না। অর্থাৎ বদল সেই জিনিস দ্বারা সাব্যস্ত হবে, যে জিনিস দ্বারা আসল বিধান সাব্যস্ত হয়। আসল বিধান তো আর বিবেক যুক্তি দ্বারা সাব্যস্ত হয় না; বদলও এমনই।” –কাশফুল আসরার: ৪/১৬৬

অর্থাৎ শরীয়তের দলীল ছাড়া শুধু নিজের বিবেক বুদ্ধি ও চিন্তা ফিকির দ্বারা যেমন কোনো জিনিসকে আল্লাহর হুকুম বলে নির্ধারণ করে দেয়া যায় না, তেমনি শরীয়ত কোনো বিধান দিয়ে থাকলে, সেই বিধান বাদ দিয়ে নিজের বিবেক বুদ্ধি ও যুক্তি দিয়ে এর বদলে অন্য কোনো কিছু গ্রহণ করারও সুযোগ নেই। কোনো কিছুকে বদল সাব্যস্ত করতে হলে শরীয়তের নস লাগবে এবং উপরোক্ত চার তরিকার কোনো এক তরিকায় তা প্রমাণ করতে হবে। শরীয়তের দলীল ছাড়া কিংবা নিজের মতো আয়াত হাদিস ব্যাখ্যা করে ঠেলেঠুলে সাব্যস্ত করতে চাইলে সাব্যস্ত হবে না।

যেমন পানি না থাকলে মাটি দিয়ে তায়াম্মুম করতে হবে। দুধ দিয়ে অযু করে নিলে পবিত্রতা অর্জন হবে না। যদিও দুধ; পানি এবং মাটি উভয়টির চেয়েই দামি। কিন্তু শরীয়ত পানির বদল দুধকে সাব্যস্ত করেনি, করেছে মাটিকে। এখন যদি কেউ আকলের ঘোড়া দৌড়ায় যে, ‘মাটি ব্যবহার করলে চেহারা ময়লা হয়ে যাবে। তার চেয়ে দুধ ভাল জিনিস তাই ব্যবহার করি। মাটি আর পানি দিয়েই যদি পবিত্রতা হয়, দুধ দিয়ে তো এর আগেই হবে।’ – তার এ যুক্তি কোনো কাজে আসবে না। দুধের নদীতে ডুবিয়ে আসলেও পবিত্রতা অর্জন হবে না।

***
উপরোক্ত উসূল দু’টি বুঝার পর এবার আসি গণতন্ত্র প্রসঙ্গে।
# যদি বলা হয়: ‘জিহাদ আসল আর গণতন্ত্র হচ্ছে তার বদল’ –তাহলে এ কথা বাতিল। নিজের মনমতো কোনো কিছুকে বদল সাব্যস্ত করলে হবে না। শরীয়তের নস লাগবে এবং সেই নস থেকে ইবারাতুন নস, দালালাতুন নস, ইশারাতুন নস ও ইকতিজাউন নস: এই চার তরিকার কোনো একটার মাধ্যমে তা সাব্যস্ত করতে হবে।

# আর যদি বলা হয়: ‘যতদিন খেলাফত ছিল ততদিন জিহাদ ছিল কিতাল ফি সাবিলিল্লাহ।খেলাফত পতনের পর থেকে সেটি মানসুখ হয়ে গেছে। এখন জিহাদ হচ্ছে গণতন্ত্র।’ – তাহলে এ কথাও বাতিল। নিজের মনমতো কোনো হুকুমকে মানসুখ বলে দিলেই মানসুখ হয়ে যায় না। তাহলে তো আরেকজন বলবে: মদের হুকুম মানসুখ। আরেকজন বলবে পর্দার হুকুম মানসুখ। আরেকজন বলবে সুদের হুকুম মানসুখ। সেগুলো যেমন বাতিল গণতন্ত্রও তেমনি।

# আর যদি বলা হয়: ‘জিহাদের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে প্রচেষ্টা। গণতন্ত্রও যেহেতু দ্বীনের নামে প্রচেষ্টা কাজেই তা জিহাদ।’ – তাহলে এ কথাও বাতিল। শরয়ী বিষয়াশয়ে আভিধানিক অর্থ ধর্তব্য নয়, যেমন সালাতের আভিধানিক অর্থ ‘দোয়া’, তাই বলে শুধু দোয়াকে সালাত বলা যায় না। বরং শরীয়ত নির্ধারিত বিশেষ আমল হচ্ছে সালাত, যাতে দোয়াও অন্তর্ভুক্ত আছে। তেমনিভাবে সব প্রচেষ্টাই জিহাদ নয়, বরং কিতাল ও কিতালের সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টা হচ্ছে জিহাদ। জিহাদের নতুন কোনো ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে সাহাবিদের নিয়ে সরেজমিনে ময়দানে দেখিয়ে গেছেন জিহাদ কোনটি। উম্মাহর সালাফে সালিহিন ও আইম্মায়ে কেরাম জিহাদের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়ে গেছেন। নতুন ব্যাখ্যা যেমন সালাতের দরকার নেই, তেমনি জিহাদেরও দরকার নেই।

ইমাম আহমাদ রহ. বর্ণনা করেন,

قَالَ: وَمَا الْجِهَادُ؟ قَالَ: ” أَنْ تُقَاتِلَ الْكُفَّارَ إِذَا لَقِيتَهُمْ. –مسند أحمد ط الرسالة: 17027، قال المحققون: حديث صحيح. اهـ “সাহাবি জিজ্ঞেস করলেন, (ইয়া রাসূল্লাল্লাহ) জিহাদ কি জিনিস? তিনি উত্তর দিলেন, ‘(জিহাদ হচ্ছে যে,) কাফেরদের সাথে যুদ্ধ বাঁধলে তুমি তাদের বিরুদ্ধে কিতাল করবে’।” –মুসনাদে আহমাদ: ১৭০২৭

তেরোশো বছর যাবত উম্মাহ জিহাদের এ অর্থই বুঝে আসছে। আপনি যেকোনো শতাব্দির যেকোনো ফকিহের যেকোনো ফিকহের কিতাব খুলে জিহাদের অধ্যায় দেখুন। জিহাদের সংজ্ঞা সবাই একটাই দিবে: কিতাল ফি সাবিলিল্লাহ।
কাজি শায়খি যাদাহ রহ. (১০৭৮ হি.) বলেন,

الجهاد في اللغة بذل ما في الوسع من القول، والفعل.
وفي الشريعة قتل الكفار ونحوُه من ضربهم ونهب أموالهم وهدم معابدهم وكسر أصنامهم وغيرهم، والمراد الاجتهاد في تقوية الدين بنحو قتال الحربيين، والذميين، والمرتدين الذين هم أخبث الكفار للإنكار بعد الإقرار، والباغين، فاللام للعهد على ما هو الأصل كما في القهستاني. –مجمع الأنهر في شرح ملتقى الأبحر (1/ 631-632)، كتاب السير “আভিধানিকভাবে জিহাদের অর্থ হচ্ছে, কথা ও কাজের যতটুকু সামর্থ্যে আছে ব্যয় করা।
আর শরীয়তের পরিভাষায় জিহাদ হচ্ছে: কাফেরদের হত্যা এবং এ জাতীয় কাজ। যেমন তাদের মারধর করা, তাদের মাল লুণ্টন করা, তাদের উপাসনালয় ভেঙে ফেলা, তাদের মূর্তি বিনাশ করা ইত্যাদি। উদ্দেশ্য: হারবি, যিম্মি, মুরতাদ ও বাগিদের বিরুদ্ধে কিতাল- এ ধরনের কাজের মাধ্যমে দ্বীন শক্তিশালী করার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালানো।” –মাজমাউল আনহুর: ১/৬৩১-৬৩২

অতএব, দ্বীনের জন্য যেকোনো প্রচেষ্টার নামই জিহাদ নয়। কাফেরদের বিরুদ্ধে কিতাল ও কতল জাতীয় প্রচেষ্টার নাম জিহাদ।
এ হচ্ছে জিহাদের মাফহুম। আজ ভিন্ন কিছুকে জিহাদ নাম দেয়ার অর্থ উম্মাহর সালাফে সালিহিন এবং তেরোশো বছরের আলেম উলামা ও আইম্মায়ে কেরামকে ভুল সাব্যস্ত করা। সুস্পষ্ট যে, এটি এক ভয়ানক বিচ্যুতি, যা ব্যক্তিকে অনেক ক্ষেত্রে ঈমান থেকেও বের করে দিতে পারে (নাউজুবিল্লাহ)।

সারকথা

শরীয়তের সুস্পষ্ট দলীল ছাড়া কোনো বিধান সাব্যস্ত করা যাবে না।

  • কোনো সাব্যস্ত বিধানকে রহিত দাবি করা যাবে না।
  • কোনো বিধানের পরিবর্তে ভিন্ন কিছুকে তার বদলরূপে গ্রহণ করা যাবে না।
  • কিংবা আভিধানিক অর্থের আশ্রয় নিয়ে নতুন কোনো বিষয় দিয়ে ঐ বিধানের ব্যাখ্যাও করা যাবে না।

কাজেই:

  • জিহাদের (কিতাল অর্থে) মেয়াদ শেষ দাবি করা;
  • গণন্ত্রকে জিহাদের বদল সাব্যস্ত করা;
  • কিংবা জিহাদের অর্থের মধ্যে গণতন্ত্রকেও ঢুকিয়ে ফেলা (তথা গণতন্ত্রকেও জিহাদ বলা); – যদি শরীয়তের সুস্পষ্ট দলীল পেশ না করা যায়, তাহলে এ সবগুলো বাতিল ও বিভ্রান্তি এবং উম্মাহর চিরাচরিত আমল ও বিশ্বাস পরিপন্থী।

***

1 thoughts on “গণতন্ত্র জিহাদ, না জিহাদের বদল?

Add yours

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

Website Powered by WordPress.com.

Up ↑

Design a site like this with WordPress.com
শুরু করুন