গত পর্বে আমরা দরবারি ফতোয়াটি দেখেছি। এবার একটু পর্যালোচনায় যাব। শায়খের সংশয়গুলোর উপর একটু আলোকপাত করবো ইনশাআল্লাহ।
প্রথমে মনে করিয়ে দিতে চাই যে, সুবিধাবাদিরা কাফের-মুরতাদদের পক্ষে যতই ওকালতি করুক; যতই তাবিল, তাহরিফ ও অপব্যাখ্যা করুক- আল্লাহ তার দ্বীনকে বিজয়ী করবেনই। আল্লাহ তাআলার চিরসত্য ওয়াদা-
“ওরা আল্লাহর নূরকে নিজেদের মুখের (ফুঁ) দ্বারা নিভিয়ে দিতে চায়, অথচ আল্লাহ তার নূরের পূর্ণনা বিধান ব্যতীত বাকি সকল কিছুতেই অসম্মত- যদিও কাফেররা (তা) অপছন্দ করে। তিনিই তো সেই সত্তা যিনি তাঁর রাসূলকে হিদায়াত ও সত্য দ্বীন দিয়ে প্রেরণ করেছেন, যেন তিনি সকল দ্বীনের উপর তাকে বিজয়ী করেন- যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে।”- তাওবা ৩২-৩৩
সংশয়: ইমামের অনুমতি
এ ব্যাপারে কিছু আলোচনা আগেও হয়েছে। তবে শায়খের বক্তব্য যেহেতু নতুন করে ফিতনার সৃষ্টি করেছে তাই কিছু আলোচনা সমীচিন করছি। ওয়ামা তাওফিকি ইল্লা বিল্লাহ।
সরকারি মোল্লারা মূলত কথার একাংশ বলে আরেকাংশ বাদ দিয়ে ফিতনার সৃষ্টি করে। পূর্ণ কথাটি বললে তখন সকলেই সঠিক বিষয়টি বুঝতে পারতো। ইমামের আনুগত্য আমরা অস্বীকার করি না, ফরয মনে করি। যেমনটা আল্লাহ তাআলা আদেশ দিয়েছেন,
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর আদেশ মান্য কর এবং আদেশ মান্য কর রাসূলের ও তোমাদের মধ্যে যারা দায়িত্বশীল, তাদের।”- নিসা ৫৯
কিন্তু এ আনুগত্য দু’টি শর্ত সাপেক্ষে:
প্রথম শর্ত:
ইমাম মুসলমান হতে হবে। কাফের কখনও মুসলমানদের ইমাম হতে পারে না। যেমনটা এ আয়াতেও বলা হয়েছে (مِنْكُمْ) তথা ইমাম মুসলমান হতে হবে। শায়খ আব্দুল্লাহ আদদুমাইজি বলেন,
“আল্লাহ তাআলার বাণী (منكم)- ‘তোমাদের মধ্য থেকে’ সুস্পষ্ট ভাষ্য যে, উলূল আমর মুসলমানদের মধ্য থেকে হওয়া শর্ত। ডক্টর মাহমুদ আলখালিদি বলেন, ‘(উলূল আমর) শব্দটি যত জায়গায় এসেছে, সব খানেই (মুসলমানদের মধ্য থেকে হওয়া) কথাটির সাথে মিলে এসেছে। বুঝা গেল, উলূল আমর মুসলমান হওয়া শর্ত’।”- আলইমামতুল উজমা ১৫৭
আল্লাহ তাআলা অন্যত্র ইরশাদ করেন,
‘আল্লাহ কিছুতেই কাফেরদের জন্য মু’মিনদের বিরুদ্ধে কোন পথ রাখবেন না।’- নিসা: ১৪১
ইবনুল হুমাম রহ. (৮৬১ হি.) বলেন,
“কোন মুসলমানের উপর কোন কাফেরের কোন কর্তৃত্ব নেই। কেননা, আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- ‘আল্লাহ কিছুতেই কাফেরদের জন্য মু’মিনদের বিরুদ্ধে কোন পথ রাখবেন না’।”- ফাতহুল কাদীর: ৫/২৬৫
দ্বিতীয় শর্ত:
আদেশ বা নিষেধ শরীয়তসম্মত হতে হবে। শরীয়ত পরিপন্থী আদেশ-নিষেধে কোন আনুগত্য নেই। যেমনটা হাদিসে এসেছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
“পছন্দ-অপছন্দ সকল বিষয়ে মুসলমানের জন্য শ্রবণ ও আনুগত্য আবশ্যক। তবে যদি গুনাহের আদেশ করা হয়, তাহলে ভিন্ন কথা। গুনাহের আদেশ করা কোন হলে শ্রবণ বা আনুগত্য নেই।”- মুসলিম ৪৮৬৯, বুখারি ৬৭২৫
এটাই আমাদের আকীদা। যেমনটা ইমাম ত্বহাবি রহ. (৩২১হি.) আহলুস সন্নাহর আকীদায় লিখেছেন,
“আমরা আমাদের আইম্মা ও আমাদের দায়িত্বশীলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা জায়েয মনে করি না- যদিও তারা জুলুম করে। তাদের বিরুদ্ধে বদ দোয়া করি না। আনুগত্যের হাতও গুটিয়ে নিই না। (বরং) তাদের আনুগত্যকে আল্লাহ আযযা ওয়াজাল্লাহ-এর আনুগত্য মনে করি ও ফরয মনে করি- যতক্ষণ তারা কোনো গুনাহের আদেশ না দেন।”- আলআকিদাতুত ত্বহাবিয়্যাহ ৪৭
শর্তের ব্যতয় ঘটলে
উপরোক্ত দুই শর্তের কোন একটায় ব্যাত্যয় ঘটলেই হুকুম বিপরীত হবে।
যদি প্রথম শর্তে ব্যত্যয় ঘটে তথা ইমাম মুসলমান না থাকে, তাহলে শরীয়তের নিদের্শ: যুদ্ধ করে হলেও তাকে অপসারণ করে দিতে হবে। যেমনটা হাদিসে এসেছে যে, হযরত উবাদ ইবনু সামিত রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,
“আমাদেরকে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ডাকলেন এবং আমরা তাঁর হাতে বাইআত হলাম। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের থেকে যে বিষয়ে বাইআত নিলেন তার মধ্যে একটি ছিল: আমরা আমাদের পছন্দনীয়-অপছন্দনীয় সকল বিষয়ে, সুখে-দুঃখে এবং আমাদের উপর যদি অন্য কাউকে প্রাধান্য দেয়া হয় তথাপি (আমীরের কথা) শুনবো ও আনুগত্য করবো এবং আমরা দায়িত্বশীলের সাথে দায়িত্ব নিয়ে বিবাদে জড়াবো না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন তবে হাঁ, যদি তোমরা কোন স্পষ্ট কুফর দেখতে পাও, যার ব্যাপারে আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে সুস্পষ্ট প্রমাণ বিদ্যমান রয়েছে- তাহলে ভিন্ন কথা।”- সহীহ বোখারি: ৬৬৪৭, সহীহ মুসলিম: ৪৮৭৭
এটি মুসলিম উম্মাহর ইজমায়ী তথা সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত। ইমাম নববি রহ. (৬৭৬ হি.) কাজি ইয়াজ রহ. (৫৪৪ হি.) এর বক্তব্য বর্ণনা করেন,
“উলামায়ে কেরাম সবাই একমত যে, কোনো কাফেরকে খলিফা নিযুক্ত করলে সে খলিফা হবে না এবং কোনো খলিফার মাঝে যদি কুফরী প্রকাশ পায়, তাহলে সে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অপসারিত হবে যাবে।”- শরহে নববি আলা মুসলিম ১২/২২৯
আরো বলেন,
“কাজী ইয়ায রহ. আরও বলেন, শাসকের উপর যদি কুফর আপতিত হয় এবং সে যদি শরীয়া বিনষ্ট করে অথবা বিদআত করে, তবে সে পদচ্যুত হয়ে যাবে এবং তার আনুগত্যের অপরিহার্যতা শেষ হয়ে যাবে।”- শরহে নববি আলা মুসলিম ১২/২২৯
হাফেয ইবনে হাজার রহ. (৮৫২ হি.) বলেন,
“কুফরীর কারণে শাসক সর্বসম্মতিক্রমে অপসারিত হয়ে যাবে। তখন প্রতিটি মুসলমানের উপর ফরজ হলো, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। যে তাতে সক্ষম হবে, তার জন্য রয়েছে প্রতিদান। যে শিথিলতা করবে, সে গুনাহগার হবে। আর যে অক্ষম, তার জন্য আবশ্য হলো ঐ ভূমি থেকে হিজরত করা।”– ফাতহুল বারি: ১৩/১৫৩
আর যদি দ্বিতীয় শর্তের ব্যত্যয় ঘটে তথা ইমাম শরীয়ত বহির্ভূত আদেশ দেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ তো করা যাবে না, তবে তার উক্ত আদেশ বা নিষেধ মেনে চলা যাবে না। বরং যা শরীয়তের নির্দেশ তাই পালন করতে হবে।
আমাদের প্রেক্ষাপট
উপরোক্ত সারসংক্ষেপ কথা বুঝার পর এবার আমাদের প্রেক্ষাপটে আসি। আমরা জানি, বর্তমান তাগুত শাসকগোষ্ঠী মুরতাদ। আল্লাহর শরীয়ত প্রত্যাখান করে কুফরি শাসন প্রবর্তন, ইসলাম ও মুসলামানদের বিপক্ষে যুদ্ধে কাফেরদের পক্ষাবলম্বন, শরীয়তের বিধি বিধান নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল ইত্যাদি অসংখ্য কারণে এরা মুরতাদ হয়ে আছে। এমতাবস্থায় জিহাদের মাধ্যমে এদেরকে অপসারণ করে মুসলিম ভূমি এদের থেকে উদ্ধার করা ফরয। তাদের আদেশ-নিষেধ মেনে চলার তো কোন প্রশ্নই নেই।
শায়খের কথা মতো যদি এসব তাগুতকে মুসলমান এবং আমীরুল মু’মিনীন ধরেও নিই, তথাপি জিহাদের অনুমতি না দেয়া বা তাতে বাধা দেয়া সুস্পষ্ট শরীয়ত বহির্ভূত কাজ। এ ধরণের আদেশ-নিষেধে কোনো আনুগত্য নেই। আল্লাহ তাআলার আদেশ আমীরের আদেশের অগ্রবর্তী। জিহাদ আল্লাহ তাআলার নির্দেশ। আমীরের নিষেধের কারণে তা থেকে বিরত থাকা যাবে না। যারা আমীরের নিষেধের কারণে জিহাদ থেকে বিরত থাকবে, তাদেরকে ফরয তরকের গোনাহ মাথায় নিয়ে অপরাধী অবস্থায় আল্লাহ তাআলার সামনে হাজির হতে হবে। এ বিষয়টি সামনে ইনশাআল্লাহ আমরা আরো একটু বিস্তারিত আলোচনা করবো।
১ম পর্ব, ৩য় পর্ব, ৪র্থ পর্ব, ৫ম পর্ব