শায়খের (আবু বকর যাকারিয়া এর কাশ্মীরে জিহাদ করা হারাম সংক্রান্ত ভিডিও) কথা থেকে বুঝা যাচ্ছে, ভারতের মোকাবেলা করার মতো শক্তি কাশ্মিরিদের নেই। ভারতের সৈন্য সংখ্যা মুসলমানদের দ্বিগুণের চেয়েও বেশি। এমতাবস্থায় জিহাদ করতে যাওয়া ‘ইলকাউন নাফস ইলাততাহলুকা’ তথা আত্মহত্যা হবে। কাজেই কাশ্মিরিদের জন্য জিহাদে দাঁড়ানো হারাম।
পর্যালোচনা
প্রথমত
কাশ্মিরে অন্তত ২০/২৫ লাখের মতো যুদ্ধোপোযোগি যুবক আছে। তারা অন্তত তাদের দ্বিগুণ তথা ৪০/৫০ লাখ মুশরিকের মোকাবেলা করতে সক্ষম। আর যদি ভারতের মুসলমানদের ধরা হয়, তাহলে সমগ্র ভারতে অন্তত ৩/৪ কোটি যুদ্ধোপোযোগি যুবক আছে। এরা অন্তত ৬-৮ কোটি মুশরিকের মোকাবেলা করতে সক্ষম। তাহলে মুসলমানরা দুর্বল কোথায়? আমাদের দুর্বলতা ফ্রিজে পানি বরফ করে রেখে ঠাণ্ডার অজুহাতে তায়াম্মুম করার মতো।
দ্বিতীয়ত
শত্রু সংখ্যা দ্বিগুণ হলে জিহাদ হারাম বলে কোন কথা শরীয়তে নেই। এটি সম্পূর্ণই বানোয়াট। ইয়াহুদিদের মানস সন্তান দরবারি আলেমরাই কেবল এ কথা বলে বেড়ায়। নতুবা কুরআন, হাদিস বা আইম্মায়ে কেরামের কারো বক্তব্যে আপনি এ ধরণের কথা পাবেন না। আল্লাহ তাআলা শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. এর উপর রহম করুন, তিনি এসব নিফাকপ্রসূত সংশয়ের অপনোদন করে উম্মাহর সঠিক রাহনুমায়ি করে গেছেন সাতশো বছর আগেই। এ ব্যাপারে قاعدة في الإنغماس في العدو তথা ‘শত্রুবাহিনির ব্যূহের ভেতরে ঢুকে আক্রমণ’ নামক তার একটি স্বতন্ত্র রিসালা রয়েছে। ইনশাআল্লাহ সেখান থেকে চয়নকৃত কিছু বক্তব্য পেশ করবো। বিস্তারিত ঐ রিসালাতে দেখা যেতে পারে।
শত্রুবাহিনি দ্বিগুণের বেশি হলে
এ ব্যাপারে প্রথমে আমরা সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাসহ কুরআনে কারীমের আয়াতগুলো দেখি। আল্লাহা তাআলা ইরশাদ করেন,
“৬৪. হে নবী! আপনার এবং আপনার অনুসারি মুমিনদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট (কাজেই জনবল ও সরঞ্জামাদির স্বল্পতায় আপনি ঘাবড়াবেন না)।
৬৫. হে নবী! আপনি মুমিনদেরকে যুদ্ধের প্রতি উৎসাহিত করুন। তোমাদের মধ্যে যদি বিশজন দৃঢ়পদ-অবিচল ব্যক্তি থাকে, তাহলে (ওদের) দু’শো জনের উপর বিজয়ী হবে। আর তোমাদের একশো থাকলে তারা কাফেরদের হাজার জনের উপর বিজয়ী হবে, কারণ তারা (কাফেররা) এমন সম্প্রদায় যারা (জিহাদের ফজিলত) বুঝে না। (তারা যুদ্ধ করে দুনিয়ার জন্য, আর তোমরা দ্বীনের জন্য এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি ও মহা প্রতিদান লাভের উদ্দেশ্যে। কাজেই তারা তোমাদের সামনে দৃঢ়পদ থাকতে পারবে না।)।”- আনফাল ৬৪-৬৫
ইসলামের শুরু যামানায় একজন মুমিন দশজন কাফেরের মোকাবেলা করা ফরয ছিল। আল্লাহ তাআলা সুসংবাদ দিয়েছেন, তোমাদের যদি একজন দশজনের মোকাবেলাও করতে হয় তথাপি তোমরাই বিজয়ী হবে। শর্ত হল, সবরের সাথে মোকাবেলা করতে হবে। কিন্তু পরবর্তীতে যখন মুহাজির ও আনসারদের বাহিরের লোকজনও মুসলমান হতে থাকলো, যাদের ঈমানী মজবুতি ও সবর তাদের সমান ছিল না, তাই তাদের পক্ষে একজন দশজনের মোকাবেলা কঠিন ছিল। এ দিকটি বিবেচনা করে আল্লাহ তাআলা দায়িত্ব হালকা করে দিয়েছেন। বিধান দিয়েছেন, একজন দু’জনের মোকাবেলা করতে হবে। দ্বিগুণের বেশি হলে মোকাবেলা ফরয নয়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
“আল্লাহ এখন ভার লাঘব করে দিয়েছেন এবং তিনি জেনেছেন যে, তোমাদের মধ্যে দুর্বলতা আছে। অতএব, তোমাদের যদি একশো দৃঢ়পদ-অবিচল ব্যক্তি থাকে, তাহলে দু’শো জনের উপর বিজয়ী হবে। আর তোমাদের এক হাজার থাকলে আল্লাহর হুকুমে দু’ হাজারের উপর বিজয়ী হবে। আর আল্লাহ সবরকারী-দৃঢ়পদ লোকদের সাথে আছেন। (সংখ্যায়-সরঞ্জামে স্বল্প হলেও আল্লাহ তাদের নুসরত করবেন)।”- আনফাল ৬৬
এখানে কয়েকটি বিষয় লক্ষ্যণীয়:
এক.
শত্রু সংখ্যা দ্বিগুণ হলে মোকাবেলা ফরয নয়। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, মোকাবেলা জায়েয নয়। বরং শরীয়তের অন্যান্য দলীল দ্বারা স্পষ্ট যে, শত্রু সংখ্যা অনেক গুণ বেশি হলেও, মৃত্যু নিশ্চিত হলেও ময়দান ত্যাগ না করে লড়াই করে যাওয়া এমনকি শহীদ হয়ে যাওয়া আল্লাহ তাআলার পছন্দ। এ ব্যাপারে আমরা সামনে ইনশাআল্লাহ দলীলভিত্তিক আলোচনা করবো। ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন,
“এখানে বেশির চেয়ে বেশি এ কথা বলা যায় যে, দ্বিগুণের বেশি হলে মোকাবেলা ফরয নয়। আয়াতে এ কথা নেই যে, মোকাবেলা মুস্তাহাব নয় বা জায়েয নয়।”- কায়িদাতুন ফিলইনগিমাসি ফিলআদুউ ৫৭
দুই.
প্রথমে একজন দশজনের মোকাবেলা ফরয ছিল। পরে আল্লাহ তাআলা স্বীয় অনুগ্রহে দায়িত্ব হালকা করে দিয়েছেন। বুঝা গেল, একজন মুমিন হিম্মত করলে দশজনের মোকাবেলা করতে সক্ষম। এক হাজার দশ হাজরের, এক লাখ দশ লাখের মোকাবেলা করতে সক্ষম। যদি তারা সবরের সাথে মোবাবেলা করে, তাহলে আল্লাহ তাআলা সুসংবাদ দিয়েছেন যে, তারা বিজয়ী হবে। জাসসাস রহ. (৩৭০হি.) বলেন,
“আল্লাহ তাআলার বাণী- ‘আল্লাহ এখন ভার লাঘব করে দিয়েছেন এবং তিনি জেনেছেন যে, তোমাদের মধ্যে দুর্বলতা আছে’: এখানে সাজ-সরঞ্জাম ও শারিরীক শক্তির দুর্বলতা উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য হল, মুশরিকদের বিরুদ্ধে কিতালের নিয়্যত ও হিম্মতের দুর্বলতা। দুর্বল হিম্মতের লোকদের ফরয যতটুকু (তথা দু’জনের মোকাবেলা করা), (উচ্চ হিম্মতের লোকসহ) সকলের বেলায় সেটুকুই ফরয করা হয়েছে।”- আহকামুল কুরআন ৩/৯২
অর্থাৎ ফরয তো সকলের জন্য একই, কিন্তু হিম্মত করলে একজন দশজনের মোকাবেলা করতে পারবে। যেমনটা আল্লাহ তাআলা অন্য আয়াতে বলেন,
“কত ছোট ছোট দল রয়েছে যারা আল্লাহর হুকুমে বড় বড় বাহিনির উপর বিজয়ী হয়েছে!! আল্লাহ সবর ও অবিচলতার পরিচয়দাতাদের সাথে আছেন।”- বাকারা ২৪৯
তিন.
দ্বিগুণের বেশি হলে মোকাবেলা ফরয নয়- এ বিধান ইকদামি জিহাদে। পক্ষান্তরে দিফায়ি জিহাদ তথা যেখানে মুসলমানরা নিজেরাই আগ্রাসনের শিকার, সেখানে বিধান ভিন্ন। সেখানে শত্রু সংখ্যা যতই বেশি হোক মোকাবেলা করতে হবে। একান্তই যদি কেউ মোকাবেলায় অক্ষম হয়ে পড়ে তার কথা ভিন্ন। ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন,
فإذا كان المؤمنون طالبين لم تجب عليهم أن يصابروا أكثر من ضعفيهم، وأما إذا كانوا هم المطلوبين وقتالهم قتال وقع عن أنفسهم فقد تجب المصابرة كما وجبت عليهم المصابرة يوم أحد ويوم الخندق مع أن العدو كانوا أضعافهم.
وذم الله المنهزمين يوم أحد والمعرضين عن الجهاد يوم الخندق في سورة آل عمران والأحزاب؛ بما هو ظاهر معروف. اهـ
“যখন মুমিনরা (কাফেরদের ভূমি বিজয়ের জন্য) কাফেরদের উপর আক্রমণ করতে যাবে, তখন দ্বিগুণের বেশির মোকাবেলা ফরয নয়। পক্ষান্তরে যখন মুমিনরা নিজেরাই আগ্রাসনের শিকার হবে এবং তাদের কিতাল হবে আত্মরক্ষার্থে, তখন মোকাবেলা ফরয। যেমন, উহুদ ও খন্দকের দিন মোকাবেলা ফরয ছিল- অথচ শত্রুবাহিনি অনেক গুণ বেশি ছিল।
উহুদের দিন যারা ময়দান ত্যাগ করে চলে গিয়েছিল এবং খন্দকের দিন যারা জিহাদবিমুখতা প্রদর্শন করেছিল, আল্লাহ তাআলা সূরা আলে ইমরান ও আহযাবে তাদের যে কত কুৎসা বর্ণনা করেছেন তা (সকলের) কাছে সুস্পষ্ট ও জানাশুনা।”- কায়িদাতুন ফিলইনগিমাসি ফিলআদুউ ৫৭
[বি.দ্র. কিতাবে ظالمين ও المظلومين লেখা আছে। তবে আলোচনার আগ-পর থেকে স্পষ্ট যে, طالبين ও المطلوبين হবে।]
উহুদে সাহাবায়ে কেরাম ছিলেন সাতশো আর কাফেররা ছিল তিন হাজার, তদ্রূপ খন্দকে সাহাবায়ে কেরাম ছিলেন তিন হাজার আর কাফেররা ছিল দশ হাজার- যা তাদের তিনগুণেরও বেশি। তখন মোকাবেলা ফরয ছিল। উহুদে মুনাফিক আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই তার তিনশো সাথীসহ চলে আসে। খন্দকে মুনাফিকরা বিভিন্ন বাহানা তুলে জিহাদ থেকে সরে পড়তে চেয়েছিল। কুরআনে কারীমে তাদের সকলের নিফাক তুলে ধরে সমালোচনা করা হয়েছে। বুঝা গেল, দিফায়ি জিহাদে সংখ্যার হিসাব নেই। সামর্থ্যানুযায়ী দিফা করতে হবে। যেমনটা ইবনে তাইমিয়া রহ. অন্যত্র বলেছেন,
“প্রতিরোধমূলক যুদ্ধ মুসলমানদের দ্বীন ও সম্মানের উপর আক্রমণকারীকে প্রতিরোধ করার সবচেয়ে গুরুতপূর্ণ স্তর, যা সর্বসম্মতিক্রমে ফরয। যে আগ্রাসী শক্তি মুসলমানদের দ্বীন-দুনিয়া উভয়টিকে ধ্বংস করে, ঈমান আনার পর তাকে প্রতিরোধের চেয়ে কোনো গুরুতর ফরয নেই। এই ক্ষেত্রে কোনো শর্ত প্রযোজ্য নয়, বরং সামর্থ্য অনুযায়ী প্রতিরোধ করতে হবে। আমাদের ফুকাহাগণ ও অন্যান্য ফুকাহায়ে কেরাম সুস্পষ্টভাবে তা বর্ণনা করেছেন।”- আলফাতাওয়াল কুবরা ৪/৬০৮
অন্যত্র বলেন,
“শত্রু যখন মুসলমানদের উপর আক্রমণ করার ইচ্ছা করে, তখন যাদের উপর আক্রমণ করতে চায়, তাদের সকলের উপর ফরজ হয়ে যায় তাদেরকে প্রতিহত করা। যাদের উপর আক্রমণ করেনি, তাদের উপরও আক্রান্তদের সাহায্যে শত্রুর মোকাবেলা করা ফরজ হয়ে যায়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আর যদি তারা দ্বীনের জন্য তোমাদের সাহায্য চায়, তাহলে তোমাদের কর্তব্য তাদের সাহায্য করা। তবে তা যেন এমন ক্বওমের বিরুদ্ধে না হয়, যাদের সাথে তোমাদের চুক্তি রয়েছে।’
যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানের সাহায্য করার আদেশ দিয়েছেন। (যার কাছে সাহায্য চাওয়া হচ্ছে) সে ব্যক্তি চাই যুদ্ধের জন্য বেতনভুক্ত হোক বা না হোক (উভয় অবস্থায়ই তার উপর আবশ্যক সাহায্য করা)। প্রত্যেকের সামর্থ্য অনুযায়ী জান এবং মাল দিয়ে সাহায্য করা ফরজ। কম-বেশি, পায়দল কিংবা সওয়ার হয়ে- যেভাবে সম্ভব।
যেমন, খন্দকের বছর (আহযাব যুদ্ধে) যখন শত্রুরা মুসলমানদের উপর আক্রমণ চালায়, তখন আল্লাহ তায়ালা কাউকেই জিহাদ থেকে বিরত থাকার অনুমতি দেননি; যেমন অনুমতি দিয়েছিলেন আক্রমণাত্মক জিহাদের বেলায়, যেখানে আগে বেড়ে কাফেরদের উপর হামলা করা হয়। সেখানে মুসলমানদেরকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন। অংশগ্রহণকারী ও তরককারী।
কিন্তু এখানে যারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে জিহাদ ত্যাগ করার অনুমতি চেয়েছিল, তাদের তিরস্কার করে বলেছেন, ‘তাদের একদল এই বলে যুদ্ধে না যাওয়ার অনুমতি চাইল যে, আমাদের বাড়ি-ঘরগুলো অরক্ষিত। অথচ বাস্তবে সেগুলো অরক্ষিত ছিল না; বরং তাদের অভিপ্রায় ছিল (কোনো উপায়ে) পালিয়ে যাওয়া’।”- মাজমুউল ফাতাওয়া ২৮/৩৫৮
ইবনুল কায়্যিম রহ. (৭৫১হি.) বলেন,
“দিফায়ি জিহাদ ইকদামি জিহাদের তুলনায় বিস্তৃত ও ব্যাপকভাবে ফরজ হয়। এ কারণেই তা প্রত্যেকের উপর ফরজে আইন। গোলাম তাতে মনিবের অনুমতি নিয়ে, না নিয়ে উভয় অবস্থায়ই জিহাদ করবে। সন্তান পিতা-মাতার এবং ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি ঋণদাতার অনুমতি ছাড়াই জিহাদ করবে।
এই প্রকার জিহাদের দৃষ্টান্ত উহুদ ও খন্দকের জিহাদ। এই প্রকার জিহাদে শত্রুসংখ্যা মুসলমানদের দ্বিগুণ বা তার কম হওয়া শর্ত নয়। কারণ, উহুদ ও খন্দকে কাফেরদের সংখ্যা মুসলমানদের চেয়ে অনেকগুণ বেশি ছিল। এরপরও জিহাদ ফরজ ছিল।
কারণ, এ জিহাদ করতে হয় জরুরি ভিত্তিতে এবং আক্রমণকারী শত্রুর প্রতিরোধে। এটি স্বেচ্ছাপ্রণোদিত (তথা ইকদামি) জিহাদ নয়।”- আলফুরূসিয়্যাতুল মুহাম্মাদিয়া ১৮৮
১ম পর্ব, ২য় পর্ব, ৩য় পর্ব, ৪র্থ পর্ব, ৫ম পর্ব
মূলঃ ইলম ও জিহাদ ভাই