জিহাদ একটি নাজুক ইবাদত। এখানে সামান্য ভুল ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। এজন্য অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের নির্দেশনা ছাড়া এখানে কাজ করা শঙ্কামুক্ত নয়। সাধারণত জিহাদের ব্যাপারে ইমামুল মুসলিমীন ও তার উমারাগণ অভিজ্ঞ হয়ে থাকেন। আর তারা হবেন-ই বা না কেন, তাদেরকে তো এ কাজের জন্যই নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তারা তো সর্বক্ষণ এ কাজেই থাকেন। অধিকন্তু যে যার মতো জিহাদ করতে গেলে বিশৃংখলা দেখা দেবে। তাই শরীয়ত আমীর উমারাদের মেনে চলতে বলেছে। ইকদামি জিহাদের ক্ষেত্রেও এ কথা, দিফায়ী জিহাদের ক্ষেত্রেও এ কথা। ইকদামি জিহাদের বিষয়টা তো স্পষ্টই।
আর দিফায়ির ক্ষেত্রেও বিষয়টা এমনই। কারণ, সব সময় এমন হয় না যে, শত্রু এসেই হঠাৎ সকলের অগোচরে হামলা করে বসে। বরং অনেক সময় আগে থেকেই জানা যায় যে, শত্রু আসছে। আবার অনেক সময় শত্রু এসে অবরোধ করে, আক্রমণ করে না। এসব ক্ষেত্রেও শরীয়ত যুদ্ধ শুরুর আগে ইমামের সাথে আলোচনা করে নিতে বলে। কারণ, সাধারণ মানুষ অনেক সময় শত্রুর অবস্থা, শক্তি, যুদ্ধের কলা-কৌশল ভাল জানে না।
উমারাগণ এসব বিষয় ভাল জানেন। তাই তাদের অনুমতি ও নির্দেশনা নিয়ে কাজ করা উচিৎ। হঠাৎ কিছু করতে গেলে বিপদের আশঙ্কা। তবে কোথাও যদি এমন হয় যে, শত্রু হামলা করে দিয়েছে এবং ইমামের নির্দেশনা নেয়ারও সুযোগ নেই, তখন ইমামের অনুমতি ছাড়াই হামলা প্রতিরোধ করবে। কারণ, ইমামের নির্দেশনা নিতে বলা হয়েছিল তো মূলত শত্রু প্রতিহত করার জন্যই। যখন ইমামের অনুমতির অপেক্ষায় থাকলে শত্রু প্রতিহত করা সম্ভব হচ্ছে না বা আরো কষ্টকর হচ্ছে, তখন আর অনুমতির দরকার নেই। এখানে নিজেরা জিহাদ শুরু করে দেয়ার মাঝেই মাসলাতাহ।
সুন্নাহ থেকে এর প্রকৃষ্ট দুটি দলীল বিদ্যমান।
এক. গাযওয়ায়ে যু কারাদ
একবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একপাল উষ্ট্রী মাঠে চড়ছিল। কাফেররা হঠাৎ আক্রমণ করে সেগুলো চিনিয়ে নেয়। হযরত সালামা ইবনুল আকওয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু বাহিরে বের হয়েছিলেন। যখন তিনি দেখলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উষ্ট্রীপাল চিনতাই হয়েছে, অনুমতির অপেক্ষা না করে এদের পেছনে ধাওয়া করেন এবং উটগুলো ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এতে খুশি হন।
যেহেতু অনুমতির অপেক্ষায় থাকলে উটগুলো উদ্ধার করা সম্ভবপর ছিল না, তাই অনুমতি ছাড়াই তিনি কিতালে জড়ান। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার এ কাজে খুশি হন এবং তার প্রশংসা করেন এবং অধিক পরিমাণে গনিমত দেন। বুঝা গেল, এ ধরণের পরিস্থিতিতে অনুমতির প্রয়োজন নেই। হাদিসটি সহীহাইনে এসেছে। মুসলিম শরীফে সালামা ইবনুল আকওয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুর যবানিতে হাদিসটি নিম্নরূপ:
“ফজরের আযান হওয়ার আগেই আমি বের হলাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুধাল উষ্ট্রীগুলো যু কারাদে চড়ছিল। তখন আব্দুর রহমান ইবনু আউফ রাদিয়াল্লাহু আনহুর এক গোলামের সাথে সাক্ষাৎ হল। সে বলল, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উষ্ট্রীপাল লুণ্টন হয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম, কে নিয়েছে? উত্তর দিল, গাতফান গোত্রের লোকেরা। তিনি বলেন, তখন আমি (মদীনাবাসীকে সতর্ক করা এবং তাদের থেকে সাহায্য চাওয়ার উদ্দেশ্যে) তিনবার ‘ইয়া সাবাহা….’ বলে চিৎকার দিলামা।
তিনি বলেন, সমগ্র মদীনায় আমার আওয়াজ পৌঁছাতে সক্ষম হলাম। এরপর দিলাম সামনের দিকে দৌঁড়। অবশেষে গিয়ে যু কারাদে তাদের নাগাল পেল। তারা তখন পানি উঠাচ্ছিল। আমি আমার তীর তাদের প্রতি নিক্ষেপ করতে লাগলাম। আর আমি ভাল তীরন্দাজ ছিলাম। … এভাবে অবশেষে তাদের থেকে সকল উষ্ট্রী উদ্ধার করতে সক্ষম হলাম এবং আরো ত্রিশটি চাদরও তাদের থেকে চিনিয়ে নিলাম। তিনি বলেন, এরপর রাসূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও অন্যান্য লোক এসে উপস্থিত হল। … তিনি বলেন, এরপর আমরা মদীনার দিকে ফিরলাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে তার উষ্ট্রীর পেছনে সওয়ার করালেন। এভাবে মদীনায় পৌঁছলাম।”- সহীহ মুসলিম ৪৭৭৮
অন্য বর্ণনায় এসেছে,
“(পরদিন) যখন সকাল হল, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমাদের শ্রেষ্ঠ ঘোড়সওয়ার আবু কাতাদা আর শ্রেষ্ঠ পদাতিক সালামা। তিনি বলেন, এরপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে গনিমতে দুই ভাগ দিলেন: এক ভাগ অশ্বারোহীর, আরেক ভাগ পদারোহীর।”- সহীহ মুসলিম ৪৭৭৯
দুই. ইমাম মুরতাদ হয়ে গেলে
ইমাম যখন মুরতাদ হয়ে যাবে, তাকে অপসারণ করা ফরয। যারা কাফের ইমামের পক্ষ নেবে, তাদের বিরুদ্ধে কিতাল করতে হবে। এটিই শরীয়তের নির্দেশ, যেমনটা হযরত উবাদা ইবনু সাবিত রাদিয়াল্লাহু আনহুর হাদিস থেকে আমরা আলোচনা করে এসেছি। এখানে তো মুসলমানদের কোন ইমাম নেই। ইমাম তো মুরতাদ হয়ে গেছে। কিন্তু ইমাম নেই বলে শরীয়ত জিহাদ বন্ধ রাখতে বলেনি। সম্ভব হলে একজনকে ইমাম বানিয়ে নেবে। সম্ভব না হলে আপাতত একজনকে আমীর বানিয়ে নিয়ে মুরতাদের বিরুদ্ধে কিতাল করবে। মুরতাদ সরে গেলে নিজেরা একজনকে ইমাম বানিয়ে নেবে। তাতারদের বিরুদ্ধে সাইফুদ্দিন কুতজ এর জিহাদ এভাবেই হয়েছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে আফগান জিহাদও এভাবেই হয়েছে।
এবার ফুকাহায়ে কেরামের কয়েকটি বক্তব্য লক্ষ করুন-
ইবনে কুদামা রহ. (৬২০ হি.) বলেন,
“শত্রু এসে পড়লে ধনী-গরীব সকলের জন্য বের হয়ে পড়া ফরয। তবে ইমামের অনুমতি ছাড়া শত্রুর দিকে রওয়ানা দেবে না। তবে যদি এমন কোন শক্তিধর শত্রু হঠাৎ আক্রমণ করে বসে যার (সাথে কিতাল করতে দেরি করলে তার) থেকে সকলে অনিষ্টের আশঙ্কা করছে, যার ফলে ইমামের অনুমতি নেয়া সম্ভব হচ্ছে না- তাহলে কথা ভিন্ন।”- আলমুগনি ৯/২১৩
সামনে বলেন,
“আমীরের অনুমতি ছাড়া বের হবে না। কারণ, যুদ্ধের দায়-দায়িত্ব তারই উপর ন্যাস্ত। শত্রুর সংখ্যা কম না বেশি এবং শত্রুর গোপন ঘাঁটি ও কৌশল-ষড়যন্ত্র সম্পর্কে তিনিই ভাল অবগত। তাই তার মতামতই মেনে নেয়া চাই। এটাই মুসলামনদের জন্য অধিক কল্যাণ। তবে শত্রু যদি আকস্মিক আক্রমণ করে বসে, যার ফলে অনুমতি নেয়া সম্ভব না হয়, তাহলে তখন অনুমতি নেয়া আবশ্যক নয়।
কেননা, তখন শত্রুর সাথে কিতাল করা এবং তার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়ার মাঝেই সনিশ্চিত কল্যাণ আর তাদেরকে ছেড়ে রাখার মাঝেই সুনিশ্চিত ক্ষতি। এ কারণেই কাফেররা যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উটপালের উপর আক্রমণ করেছিল এবং সালামা ইবনুল আকওয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু মদীনার বাহিরে তাদের নাগাল পেলেন, তিনি অনুমতি ছাড়াই তাদের পেছনে ধাওয়া করলেন এবং কিতাল করলেন। এতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার প্রশংসা করে বলেছেন, ‘সালামা আমাদের পদাতিক বাহিনির শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা’ এবং তাকে একজন ঘোড়সওয়ার ও একজন পদাতিক যোদ্ধার সমপরিমাণ গনিমত দিয়েছেন।”- আলমুগনি ৯/২১৩-২১৪
এ আলোচনা ফরযে আইনের সময়কার। মাসলাহাতের খাতিরে এখানেও অনুমতির কথা বলেছেন। তদ্রূপ যখন অনুমতির অপেক্ষায় না থেকে কিতাল শুরু করার মাঝেই মাসলাহাত তখন অনুমতি ছাড়াই জিহাদ শুরু করতে বলেছেন। বুঝা গেল, ইমাম বা আমীরের অনুমতি এমন কোন বিষয় নয় যা ব্যতীত জিহাদ সর্বাবস্থায় নাজায়েয। বরং বিষয়টি মাসলাহাতের সাথে সম্পৃক্ত।
খতিব শারবিনি রহ. (৯৭৭ হি.) বলেন,
“কাফেরদের প্রভূত শক্তিধর কোন সম্রাট আমাদের (দারুল ইসলাম) রাষ্ট্রের সীমান্তে প্রবেশ করে গেলে (আমীরের অনুমতি ও নির্দেশনা ছাড়া) ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল বা সাধারণ জনগণ তাকে প্রতিহত করতে তাড়াহুড়া করে কোন ব্যবস্থা নেবে না। কেননা, এতে ভীষণ বিপদের আশঙ্কা আছে।”- মুগনিল মুহতাজ ৬/২৪
এ আলোচনাও ফরযে আইনের বেলায়। কিন্তু বিপদের আশঙ্কা আছে বিধায় ইমামের অনুমতি ছাড়া জনগণ তড়িঘড়ি কোন ব্যবস্থা নিতে নিষেধ করা হয়েছে। তবে আকস্মিক শত্রু আক্রমণ করে বসলে ভিন্ন কথা- যেমনটা উপরে বর্ণিত হয়েছে।
ইবনে কুদামা রহ. (৬২০ হি.) বলেন,
“যদি ইমাম না থাকে তাহলে এ কারণে জিহাদ পিছিয়ে দেয়া যাবে না। কেননা, পিছিয়ে দেয়ার দ্বারা জিহাদে নিহিত মাসলাহাত ও কল্যাণসমূহ হাতছাড়া হয়ে যাবে। গনীমত লাভ হলে হকদারদের মাঝে শরীয়তে বর্ণিত নিয়মানুযায়ী বণ্টন করে নেবে। তবে কাজী রহ. বলেন, ইমাম নির্ধারণ না হওয়া পর্যন্ত সতর্কতাবশত দাসীদের বণ্টন স্থগিত রাখবে।”- আলমুগনী ১০/৩৭৪
বুঝা গেল, জিহাদ ফরযে আইন হোক আর ফরযে কিফায়া হোক সকল অবস্থায় ইমাম বা আমীরের নির্দেশনা মেনে চলতে হবে। এর মাঝে মাসলাহাত। তবে যখন অনুমতি নিতে গেলে মাসলাহাত নষ্ট হবে, তখন অনুমতি ছাড়াই জিহাদ করবে। তদ্রূপ যদি ইমাম না থাকে, তথাপি বসে থাকা যাবে না। অবশ্য জিহাদ শুরু করার সময় তৎক্ষণাৎ একজনকে আমীর বানিয়ে নেবে। তদ্রূপ আমীর শহীদ হয়ে গেলেও একজনকে ততক্ষণাৎ আমীর বানিয়ে নেবে, যাতে শৃংখলা ঠিক থাকে; যেমনটা মূতার যুদ্ধে সাহাবায়ে কেরাম করেছিলেন।
ইবনে কুদামা রহ. (৬২০ হি.) বলেন,
“ইমাম যদি কাউকে আমীর নির্ধারণ করে তার নেতৃত্বে কোন বাহিনি পাঠান, অতঃপর উক্ত আমীর নিহত হয় বা মারা যায়, তাহলে বাহিনি নিজেরা নিজেদের একজনকে আমীর বানিয়ে নিতে পারবে। যেমনটা মূতার যুদ্ধে সাহাবায়ে কেরাম করেছিলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কতৃক নির্ধারিত আমীরগণ যখন সকলে শহীদ হয়ে যান, তখন তারা খালেদ বিন ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহুকে নিজেদের আমীর বানিয়ে নেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এ সংবাদ পৌঁছলে তিনি তাদের এ কাজে সন্তুষ্ট এবং একে সঠিক বলেন। সেদিনই খালেদ রাদিয়াল্লাহুকে তিনি ‘সাইফুল্লাহ’- ‘আল্লাহর তরবারি’ উপাধি দেন।”- আলমুগনি ৯/২০২-২০৩
ইমাম মুহাম্মাদ রহ. (১৮৯ হি.) বলেন,
“(যুদ্ধের ময়দানে যাওয়ার পর) আমীরের ঘোষক যদি ঘোষণা দেয় যে, দানা পানির জন্য বাহিরে যাওয়া নিষেধ- তাহলে সংঘবদ্ধ হোক বা না হোক- কারো জন্যই বাহিরে যাওয়া উচিৎ হবে না। তবে ইমামের উচিৎ দানা পানির জন্য কিছু লোককে পাঠানো এবং পাঠানোর সময় একজনকে আমীর বানিয়ে দেয়া। যাতে তারা পরস্পর ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারে এবং মুশরিকদের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হলে যেন যুদ্ধ করতে সমর্থ্য হয়।
তদ্রূপ ইমাম নিষেধ করার পূর্বেই যদি (আমীর ছাড়া) বিক্ষিপ্তভাবে বেরিয়ে পড়ে অতঃপর তাদের উপর শত্রুরা আকস্মিক আক্রমণ করে বসে, তাহলে তাদের উচিৎ ঐক্যবদ্ধ থাকা এবং একজনকে আমীর বানিয়ে নেয়া তারপর যুদ্ধ শুরু করা।”- শরহুস সিয়ারিল কাবির ১/৯৪
সারমর্ম
উপরোক্ত আলোচনার সারমর্ম, জিহাদের জন্য একজন আমীর এবং তার নির্দেশনা আবশ্যক। আমীরের অনুমতি ব্যতীত নিজেরা কিছু করতে যাবে না। তবে বিষয়টি মাসলাহাতের সাথে সম্পৃক্ত। যেখানে আমীরের অনুমতি নিতে গেলে মাসলাহাত ছুটে যাবে, সেখানে আমীরের অনুমতি নিতে হবে না। আমীরের অনুমতি ছাড়াই জিহাদ করবে। তবে উপস্থিত সময়ে ঐক্য ঠিক রাখার জন্য আমীর না থাকলে একজনকে আমীর বানিয়ে নেবে। তদ্রূপ আগের আমীর শহীদ হয়ে গেলে বা মারা গেলেও নিজেদের একজনকে আমীর বানিয়ে নেবে তারপর কিতাল শুরু করবে। আমীর না বানিয়ে কিতাল শুরু করা উচিৎ নয়।
যখন প্রমাণ হল, আমীরের সম্পর্ক মাসলাহাতের সাথে তখন আমাদের সামনে নিম্নের সূরতগুলো আপনা আপনি সমাধান হয়ে যাবে:
ইমাম ফরযে আইন জিহাদে বাধা দিলে
ইমাম মুহাম্মদ রহ. ‘আসসিয়ারুল কাবীর’ এ বলেন,
“ইমাম যদি লোকজনকে যুদ্ধ করতে এবং কিতালে বের হতে নিষেধ করে, তাহলে তাদের জন্য তার আদেশ অমান্য করা জায়েয হবে না। তবে যদি নাফীরে আম হয়ে যায় তাহলে ভিন্ন কথা।” -শরহুস সিয়ারিল কাবীর: ২/৩৭৮
অর্থাৎ নাফিরে আম হয়ে গেলে তথা কাফেররা মুসলিম ভূখণ্ডে আগ্রাসন চালালে ইমাম নিষেধ করলেও জিহাদে যেতে হবে। কাফেররা আক্রমণ করার কারণে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে জিহাদ ফরযে আইন হয়ে গেছে। ইমাম যদি এ জিহাদে বের হতে নিষেধ করেন, তাহলে তিনি আল্লাহর আদেশের পরিপন্থী আদেশ দিলেন যা মান্য করা যাবে না। যেমনটা আমরা আগে আলোচনা করে এসেছি। আরেকটি হাদিসে কথাটি এভাবে এসেছে,
“খালেকের নাফরমানী করে মাখলূকের আনুগত্য বৈধ নয়।”-মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা: ৩৪৪০৬
মালিকী মাযহাবের কিতাব ‘ফাতহুল আলিয়্যিল মালিক’ এ বলা হয়েছে:
“ইবনে হাবীব রহ. বলেন, আমি আহলে ইলমদেরকে বলতে শুনেছি, ইমাম কোন মাসলাহাতের প্রতি লক্ষ্য করে কিতাল করতে নিষেধ করলে তার বিরুদ্ধাচরণ করা হারাম। তবে যদি শত্রু আক্রমণ করে বসে তাহলে ভিন্ন কথা। ইবনে রুশদ রহ.বলেন, ইমাম ন্যায় পরায়ণ না হলেও তার আনুগত্য আবশ্যক, যতক্ষণ না কোন গুনাহের আদেশ দেন। আর ফরযে আইন জিহাদে বাধা দেয়া গুনাহের কাজ।”- ফাতহুল আলিয়্যিল মালিক: ৩/৩
আল্লামা ইবনে হাযম রহ. বলেন-
“কুফরের পর কাফেরদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা থেকে বাধা দেয়া এবং মুসলমানদের ভূমিকে তাদের হাতে সমর্পণ করতে আদেশ করার চেয়ে বড় কোন গুনাহ নেই।” -আল-মুহাল্লা: ৭/৩০০
অতএব, ইমাম জিহাদে বাধা দিলে তার নিষেধাজ্ঞা মান্য করা যাবে না। শত্রু আক্রমণ করে বসলে আল্লাহ তাআলার আদেশ হল তাদের বিরুদ্ধে কিতাল করা। আল্লাহ তাআলার আদেশের সামনে ইমামের নিষেধের কোন মূল্য নেই।
ইমাম জিহাদ না করলে বা জিহাদের অনুমতি না দিলে
ইবনু আসাকির রহ. (৫৭১হি.) আহমাদ ইবনু সা’লাবা আলআমিলি রহ. থেকে বর্ণনা করেন,
“জালেম ইমামের সাথে মিলে শত্রুর (তথা কাফেরদের) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ব্যাপারে ওয়াকি’ ইবনুল জাররাহ রহ. (১৯৭হি.) এর কাছে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। তিনি উত্তর দেন, জালেম হলেও যদি যথাযথভাবে জিহাদ করে, তাহলে তার সাথে মিলেই যুদ্ধ কর। পক্ষান্তরে যদি শত্রুদের থেকে ঘুষ নেয় এবং তাদের সাথে স্বজনপ্রীতির আচরণ করে, তাহলে তুমি তোমার নিজের মতো করে (আলাদা) জিহাদ করো।”- তারিখে দিমাশক ৭১/৪৭
লক্ষ্যণীয়, ইমাম বিদ্যমান থাকাকালেও যদি ইমাম খিয়ানত করে, অর্থের লোভে জিহাদ বন্ধ করে দেয় বা শত্রুদের সাথে স্বজনপ্রীতি দেখায়, তাহলে ইমামের অনুমতি ছাড়াই আলাদা জিহাদ করার কথা বলেছেন। এ কথা বলেননি যে, ইমাম জিহাদ বন্ধ করে রাখলে, তিনি অনুমতি না দিলে নিজে থেকে জিহাদ করতে যেও না; নিজে থেকে করতে গেলে হারাম হবে- এসব কিছুই বলেননি। বরং জিহাদ করতে বলেছেন। এবার আমাদের সরকারগুলোর অবস্থা বিবেচনা করুন।
খতীব শারবিনী শাফিয়ি রহ. (৯৭৭ হি.) বলেন,
تنبيه : استثنى البلقيني من الكراهة صورا .
إحداها : أن يفوته المقصود بذهابه للاستئذان .
ثانيها : إذا عطل الإمام الغزو وأقبل هو وجنوده على أمور الدنيا كما يشاهد .
ثالثها : إذا غلب على ظنه أنه لو استأذنه لم يأذن له . اهـ
“ইমাম বা তার নায়েবের অনুমতি ছাড়া জিহাদ মাকরুহ। … তবে বুলকিনি রহ. কয়েক সূরতকে এর ব্যতিক্রম বলেছেন।
১. অনুমতি নিতে গেলে যদি জিহাদের মূল উদ্দেশ্য হাতছাড়া হয়ে যায়।
২. যদি ইমাম ও তার সৈন্য-সামন্ত জিহাদ ছেড়ে দুনিয়ার ভোগ বিলাসিতায় লিপ্ত হয়ে যায়।
৩. যদি প্রবল ধারণা হয় যে, অনুমতি চাইলে অনুমতি দেবে না।” – মুগনিল মুহতাজ: ১৭/২৮৭
অর্থাৎ যদি শত্রু আক্রমণ করে বসে আর ইমামের অনুমতি নিতে গেলে শত্রুর পক্ষ থেকে ক্ষতির আশঙ্কা থাকে, তাহলে অনুমতি ছাড়াই জিহাদ করবে। কেননা, এখানে অনুমতি নিতে গেলে জিহাদের উদ্দেশ্য- তথা শত্রু প্রতিহত করা- ব্যহত হবে। তদ্রূপ ইমাম যদি জিহাদ ছেড়ে বসে থাকে বা কোন ওজর ছাড়াই কাউকে জিহাদে যেতে নিষেধ করবে মনে হয়ে থাকে, তাহলে ইমামের অনুমতি ছাড়া নিজেরাই জিহাদ করে নেবে। শারবিনী রহ. এর বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে, জিহাদ আল্লাহ তাআলার বিধান। ইমাম শুধু শৃংখলার জন্য। যখন ইমামের অনুমতি নিতে গেলে যখন এ ফরযে ব্যাঘাত ঘটার আশঙ্কা থাকবে, তখন অনুমতি নেবে না। তদ্রূপ, ইমাম এ ফরয আদায়ে গাফলতি করলে নিজেদের দায়িত্ব নিজেদেরকেই আদায় করতে হবে।
কাশ্মীর জিহাদ ও রাষ্ট্র প্রধানের অনুমতি
পূর্বোক্ত আলোচনা থেকে বুঝলাম: ইমাম না থাকলেও জিহাদ ছাড়া যাবে না; তদ্রূপ ইমাম জিহাদ না করলে, অনুমতি না দিলে বা বাধা দিলে ইমামের অনুমতি ব্যতিরেকেই জিহাদ করে নিতে হবে। অর্থাৎ আমরা জিহাদের দায়িত্বটা ইমামের হাতে তখনই ন্যাস্ত করবো, যখন ইমাম নিয়মিত জিহাদ করবেন। এর ব্যতিক্রম হলে নিজেদের দায়িত্ব নিজেদেরকেই আদায় করতে হবে।
এবার আমাদের বাংলাদেশসহ অন্য সকল তাগুতি রাষ্ট্রের দিকে তাকাই। আমাদের বিশ্বাস অনুযায়ী এরা মুরতাদ। স্বয়ং এদের বিরুদ্ধেই জিহাদ ফরয। আর তাদের আনুগত্যের তো কোন প্রশ্নই আসে না। যেমনটা আল্লাহ তাআলা আদেশ দিয়েছেন,
“হে নবী, আপনি আল্লাহকে ভয় করুন এবং কাফের মুনাফিকদের আনুগত্য করবেন না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজান্তা ও মহাপ্রজ্ঞাময়।” – সূরা আহযাব: ১
কাজেই তাদের আদেশ নিষেধের কোন মূল্য নেই।
আর আবু বকর যাকারিয়া সাহেবের মতো যারা এদেরকে মুসলমান এবং আমীরুল মুমিনীন মনে করেন, তাদের ধারণা অনুযায়ীও কাশ্মীর বা অন্য কোন ভূখণ্ডে জিহাদে যেতে এদের অনুমতি লাগবে না। তারা যখন জিহাদ ছেড়ে দিয়েছে, অন্যদেরকেও করতে দিচ্ছে না, বরং তারা নিজেরাই কাফেরদের বাহিনিতে পরিণত হয়েছে, তখন এদের আদেশ নিষেধের কোন মূল্য নেই। কাজেই বর্তমান তাগুতি রাষ্ট্রগুলোতে বসবাসরত যেকোন মুসলমান – নিরাপত্তা ও মাসলাহাতের দিকটি বিবেচনায় রেখে- পৃথিবীর যেকোন রাষ্ট্রে গিয়ে জিহাদে শরীক হতে পারবে। শরয়ী *দৃষ্টিকোণ থেকে কোনই বাধা নেই; বরং এটাই দায়িত্ব। অবশ্য আগেও বলেছি,
- যার-তার কথায় চলে যাবে না। মুজাহিদদের সাথে নিরাপদ ও পাকাপোক্ত যোগাযোগ হওয়ার পরই কেবল যাবে।
- তদ্রূপ এ কথাও বলেছি, নিজ দেশের তাগুতদের বিরুদ্ধে জিহাদের দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা করাই নিয়ম। বিশেষ দরকার পড়লেই কেবল অন্য ভূমিতে হিজরত করবে, অন্যথায় নয়। সারা দুনিয়াই এখন জিহাদের ময়দান। সুবিধামতো সব জায়গাতেই জিহাদের ঝাণ্ডা বুলন্দ করতে হবে। ওয়াল্লাহু আ’লাম।
১ম পর্ব, ২য় পর্ব, ৩য় পর্ব, ৪র্থ পর্ব, ৫ম পর্ব
মূলঃ ইলম ও জিহাদ ভাই