জিহাদঃ ফ্যান্টাসি বনাম বাস্তবতা

আলহামদুলিল্লাহ্।  এই ফোরামে যখন ভিজিট করি তখন খুব ভাল লাগে। মনে হয় দেশটা মুজাহিদদের পদচারনায় উদীপ্ত; এই বুঝি হাসিনার মসনদ হেলে পরল এবং আগামীকাল ঘুম থেকে উঠেই দেখব রাস্তাঘাটের যত্রতত্র অশ্লীল পোস্টারগুলো সব ভ্যানিশ হয়ে গেছে, বিলবোর্ড গুলোতে শোভা পাচ্ছে কুরআনের আয়াত ও হাদীস, অর্ধ উলঙ্গ নারীদের দাপটে প্রায় বাঁকা হয়ে যাওয়া ঘাড়টা বুঝি আবার সোজা হওয়ার সুযোগ পেল, মসজিদে ইমামদের মিম্বারের পাশে একে-৪৭ শোভা পাচ্ছে, পাড়ার মোড়ে মোড়ে পান-বিরি-সিগারেটের আড্ডাগুলো দখল করেছে ইসলামী হালাকা, শেখ হাসিনার ক্ষমতায় জঙ্গীবাদের সুযোগ নাই এই শ্লোগানের জায়গায় ‘জিহাদ জিহাদ জিহাদ চাই, জিহাদ ছাড়া গতি নাই’ স্লোগানে মুখরিত, পত্রিকায় পাত্র চাই বিজ্ঞাপনে ‘এমবিএ/ইঞ্জিনিয়ার/ডাক্তার পাত্রের জায়গায় জঙ্গী পাত্রের খোঁজে পাত্রীর পিতারা হয়রান…

কিন্তু আফসোস পরের দিন ঘুম ভাঙ্গে এবং দেখি সবকিছুই আগের মতই আছে এবং খারাপের দিকে কিঞ্চিৎ অগ্রগতিও পরিলক্ষিত হয়। অতঃপর ভাবতে বসি সমস্যা আসলে কোন জায়গায়… আমাদের কমতি আসলে কোন জায়গায়। কেন মিডিয়াতে দেখা এত এত জবজাবান ভাইদের উপস্থিতিতে সরগরম করা ভূমির এই হাল। তখন দীর্ঘশ্বাসের সাথে একটা আপ্ত বাক্যই বের হয়ে আসে তা হলঃ আমাদের লম্ফঝম্ফ সব এখন ইন্টারনেট কেন্দ্রিক হয়ে গেছে। বাস্তবতার সাথে এর আকাশ পাতাল দূরত্ব। আসুন ছোট্ট কিছু উদাহরণ দেখে নিই যা থেকে এটা আরও সহজে বুঝে আসে–

—-জিহাদের চাহিদা / আমাদের অবস্থা —-
আমাদেরকে গাজওয়ায়ে হিন্দের জন্য শারীরিকভাবে প্রস্তুত হতে হবে/ সকালে ব্যায়াম করার সময়-আচ্ছা আজকের দিনটা একটু ঘুমাই কাল থেকে ব্যয়াম করব।
শামের ভাইরা খাবারের অভাবে ফতোয়া চেয়েছে বিড়াল খাওয়া জায়েজ হবে কিনা/খাবার সময়- আম্মা তরকারিতে লবন বেশি হইছে, ঝাল কম হইছে…
বরফের উপর হামাগুড়ি দিয়ে হলেও এই বাহিনীর সাথে শরীক হতে হবে/ ভাই বাইরে বৃষ্টি আজকে হালাকাতে আসতে পারব না।
সাহাবা (রাঃ) গণ এক ময়দান থেকে আরেক ময়দানে গেছেন/আমাদের ময়দান অফিস থেকে আহলিয়ার কাছে, আহলিয়ার কাছে থেকে অফিস
জেনে নিন জিহাদের পথে ৮টি বাঁধা/ভাই আমাকে একটু যেতে হবে বাসায় আহলিয়া একা।
জান ত সবাই দিতে পারে আগে মাল দিয়ে শরীক হোন/বাসার এসিটা ঠিক করাতে গিয়ে এই মাসের সব টাকা শেষ হয়ে গেছে।
তাগুত-মুরতাদরা ভয়ে দিশেহারা হয়ে গেছে; মাথায় হাত মনিরুলের/ভাই দাড়ি রাখার পর থেকে সবাই কেমন কেমন করে যেন তাকায়
জেনে নিন জিহাদে শরীক থাকার ৪৪টি উপায় এবং আজই শরীক হয়ে যান/হ্যা পড়ছি ৪৪ টি উপায় কিন্তু কোনটার সাথে যে আসলে আমি ম্যাচ করি…গভীর চিন্তিত
শহীদের রক্তের প্রথম ফোটা বের হওয়ার সাথে সাথে তাঁর সব গুনাহ মাফ…/ভাই বাসায় থাকবেন…কিন্তু যদি পুলিশ রেইড দেয়…

এবং এভাবে যদি লেখা হয় ত সেই তালিকার বুঝি শেষ হবে না।
প্রিয় ভাইয়রা, আমরা সেই সব সাহাবা (রাঃ) দের উত্তরসূরি যারা কথা বলতেন কম কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে ছিলেন অগ্রগামী। আমাদের মত এত ইলমের ফুলঝুরি নিয়ে উনারা বসে থাকতেন না। বরং যতটুকু আছে তাঁর উপর আমল করতেন। খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ) এর জিহাদি জীবনে সূরা ফাতিহা বাদে মাত্র ৪টা সূরা মুখস্ত পারতেন (৩ কুল এবং সূরা কাউসার)–এটা আমি এক ভাইয়ের কাছ থেকে শুনেছি তথ্যসূত্র জানি না। কিন্তু উনার নাম শুনলে তৎকালীন দুই সুপার পাওয়ার ভয়ে থরথর করে কাঁপত। কারণ উনি শুধু মুখের বুলি আওরাতেন না বরং ময়দানে উনার উপস্থিতি ছিল সেরকম। উনাদের বাইরের সাথে ভিতরের কোন পার্থক্য ছিল না বরং অনেকাংশে বাইরের চেয়ে ভিতরটা ছিল আরও চমৎকার। তাই আমরা যদি বাস্তবেই তাঁদের অনুসরণ করতে চাই যেমনটা আমরা আমাদের প্রোফাইল নেম রেখে প্রমাণ করতে ব্যস্ত তবে নিজেদের অনলাইন জীবনের সাথে বাস্তবতার পার্থক্য কমিয়ে ফেলা জরুরী না বরং আবশ্যক।

একটা ছোট্ট গল্প বলিঃ
আমাদের দেশের প্রখ্যাত এক মাদ্রাসার মহামান্য শাইখুল হাদিস এবং সাথে আরও অনেক টাইটেল যোগ করা ব্যক্তিত্ব। উনার মনে খুব আফসোস আফগান জিহাদের প্রথম পর্বে (রাশিয়ার সাথে) দেশের যত নাট্টু-গাট্টু (বিশেষণ টা আমার দেওয়া না আমার প্রিয় শায়েখ আবু ইমরান হুজুরের দেওয়া) সবাই নিজেদের নামের আগে মুজাহিদ টাইটেল নিয়ে এসেছে। কিন্তু উনি এত বড় একজন শায়খ হওয়ার পরেও এটা পারেন নাই। তাই আফগান জিহাদের দ্বিতীয় পর্ব (আমেরিকা ও ন্যাটোর সাথে) শুরু হতেই তিনি নিজে নিজে বললেন এইবার আর সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না। একবার যা ভুল করার করছি। তাই মোটামুটি পরিচিত সবার কাছে জানান দিয়ে মুজাহিদ টাইটেল নিতে ছুটলেন আফগানিস্তানে। কিন্তু ময়দানে পৌঁছে উনার চোখ কপালে উঠে গেল। আফগান জিহাদের শুরুর দিকে তখন শত শত তালেবান ভাইরা শহীদ হচ্ছেন, অনেকে আহত হচ্ছেন। এই দৃশ্য দেখে উনার মুজাহিদ টাইটেল নেওয়ার সাধ শিকেয় উঠতে বেশি সময় লাগল না। ফলাফল যে গতিতে আফগানিস্তান গিয়েছিলেন তার চেয়ে শতগুন গতিতে মাদ্রাসার নিরাপদ প্রাঙ্গনে ফেরত আসলেন। সবাই তখন হায় হায় করে উঠল কি করলেন শায়খ আপনি জিহাদের ময়দান থেকে ফেরত আসলেন। মহামান্য শায়খ তখন বললেন, ‘এই নি জিহাদ। এটা যদি হক্কের জিহাদ হয় ত আল্লাহ্*র নুসরা কই?’

প্রিয় ভাই আমাদের এই মহামান্য শায়খ হয়ত ভেবেছিলেন তিনি যাবেন গিয়ে দেখবেন আগেকার দিনে রাজা-রাজরারা পাখি শিকারে যাওয়ার সময় যেমন পাইক-পেয়াদারা সব কিছু গোছগাছ করে রাখত এবং পারলে পাখি ধরে একটা গাছের সাথে বেঁধে বন্দুক তাক করে রাখত আর রাজারা গিয়ে ট্রিগারে চাপ দিত আর সবাই হাত তালি দিত উনার ক্ষেত্রেও মনে হয় তাই হবে। জিহাদের ময়দানে যাবেন দুই-চারটা ট্রিগারে চাপ দিয়ে মুজাহিদ টাইটেল নিয়ে দেশে ফিরে আসবেন। তাই আপনাদেরকে বলছি ভাই আমরা এখনো যারা জিহাদটাকে এই মহামান্য শায়খের মত মনে করছি তারা এখনো সময় আছে ভাই নিজেদের শুধরে নেন। কারণ আজকে না হয় আপনার দরজায় ময়দান নাই তাই ইন্টারনেটে বীরত্ব দেখিয়ে পার পাচ্ছেন কিন্তু আল্লাহ্* না করুক কালকে আপনার সামনে যখন ময়দান উন্মোচিত হবে তখন যেন এই শায়খের মত বলতে না হয় ‘এই নি জিহাদ’।

আল্লাহ্ তাআলা আমাদের সবাইকে সংশোধিত হওয়ার তৌফিক দান করুন। আমিন।।

নোটঃ ভাই এই অধম গতকালও ছিল জাহান্নামের ঘূর্ণিপাকে বিচরণরত। আর আজকে আল্লাহ্* সুবঃ একটু হিদায়েতের দেখা দিয়েছেন আর তাতেই এত বড় বড় বুলি আওরাচ্ছি। আল্লাহ্* আমাকে মাফ করুন। এই ধরণের লেখা কোনভাবেই আমার লেখা শোভা পায় না। কিন্তু ভাই আপনাদের প্রতি অপরিসীম ভালবাসার জন্যই এটা লিখলাম। কারণ বাস্তবতার সাথে অনলাইনের পার্থক্য দেখে প্রতি পদে পদে ধন্দে পরতে হচ্ছে।


মূলঃ আবু ফাতিমা

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

Website Powered by WordPress.com.

Up ↑

Design a site like this with WordPress.com
শুরু করুন