আরাকানে রয়ে যাওয়া অবশিষ্ট রোহিঙ্গাদের দুর্বিষহ জীবনযাপনের খণ্ডচিত্র

আজ থেকে পাঁচ বছর আগে ২০১৭ সালের আগস্ট ও সেপ্টেম্বরের দিকে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও উগ্র বৌদ্ধ সন্ত্রাসীরা পরিকল্পিত গণহত্যা চালায়। এ ছিল যুগের নব্য তাতারেরা হামলে পড়ে মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর। মুসলিম নারী-শিশুদের ওপর চালানো হয় পাশবিকভাবে গণধর্ষণ। পুরুষদের দেখলেই চালানো হচ্ছিল গুলি। বৌদ্ধ মগ জাতীর দেয়া আগুনে জ্বলে ছারখার হচ্ছিল আরাকানের মুসলিম গ্রামগুলো।

ওই সময় লাখ লাখ রোহিঙ্গা নিজেদের ধন-সম্পদ, গোয়াল ভরা গরু, গোলাভরা ধান, সবুজ ফসলি জমি, পুকুর ভরা মাছ সব কিছুর মায়া ত্যাগ করে প্রাণে বাঁচতে ছুটে চলেন অজানা গন্তব্যের দিকে। বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ভারতসহ নানা দেশে পালিয়ে বাঁচতে চেষ্টা করে তারা। তবে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক রোহিঙ্গা মুসলিম আশ্রয় নেন প্রতিবেশী বাংলাদেশে। বর্তমানে অন্তত ১০ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম বাংলাদেশে আশ্রয় কেন্দ্রে বন্দী অবস্থান জীবনযাপন করছেন।



তবে এখনো আনুমানিক ৬ লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমারে রয়ে গেছেন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, সেখানে তারা বর্ণবাদ, নিপীড়ন এবং চলাফেরায় কঠোর বিধিনিষেধাজ্ঞার মধ্যে জীবনযাপন করছেন।

আরাকানে রয়ে যাওয়া মানুষদের একজন মুহাম্মদ। তিনি যে এলাকায় রয়ে গিয়েছিল তাদের গ্রামটি মিয়ানমার সেনাদের থেকে রেহাই পেয়েছিল। বর্তমানে গত দুই মাস ধরে এলাকাটি কিছুটা শান্ত। তবে এলাকাটি ঠিক কারাগারের মতো। মুহাম্মদ জানান, আমরা গ্রামের বাইরে যেতে পারিনা, কোন খাবার সংগ্রহ করতে পারছিনা।



সেখানে রয়ে যাওয়া মুসলিমরা কঠোর বাস্তবতার মুখে রয়েছে৷ শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, ও জীবিকা নির্বাহের মতো মৌলিক বিষয়গুলো থেকে বাধা দেয়াসহ তাদের চলাচলের উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, গণহত্যার পর থেকে আনুমানিক ২ হাজার রোহিঙ্গাকে গ্রেফতার করেছে সেনারা। তাদের মধ্যে কয়েকশ শিশুকে সামরিক বাহিনীর অনুমতি ব্যতীত বাহিরে যাবার কারণে গ্রেপ্তার করা হয়েছেন।

মুহাম্মদ নামে আরও জানান, “আমরা নামে মাত্র মানুষ, আমরা এখানে পশুর মত বসবাস করছি। এমনকি পশুরাও আমাদের থেকে সুখী, আমারা আমাদের দুঃখটুকুও প্রকাশ করতে পারি না। কোন হাসপাতালে চিকিৎসা করতে পারিনা। কারণ হাসপাতালে যাবার অনুমতি প্রয়োজন। তাছাড়া হাসপাতালেও আমাদেরকে বৈষম্যের সম্মুখীন হতে হয়।

ফোরটিফাই রাইটসের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ জাও উইন বলেন, রোহিঙ্গাদের জাতীয় ভেরিফিকেশন কার্ড (এনভিসি) নেয়ার জন্য সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে চাপ দেয়া হচ্ছে। এই কার্ড তাদেরকে মিয়ানমারের নাগরিক হওয়া সত্বেও “বিদেশী বাঙালি” হিসেবে চিহ্নিত করবে। রোহিঙ্গারা যদিও এনভিসি কার্ড গ্রহণ করতে চাচ্ছেন না, এরপরও এটি তাদের বাধ্য হয়ে করতে হবে। কেননা এটি ছাড়া এখানে তারা প্রয়োজনীয় কোন কাজই করতে পারবেনা। বিদেশি সংস্থার সাহায্যসহ সবকিছুতেই এটি প্রয়োজন হবে।

বর্তমানে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গারা দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীর নিপিড়নের শিকার হচ্ছেন। একদিকে সামরিক বাহিনী অন্যদিকে আরাকান আর্মি। আরাকান আর্মি রাখাইনে ২০১৯ ও ২০২০ সাল থেকে মায়ানমার সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। এবং বর্তমানে রাখাইন রাজ্যের বিশাল একটি অংশ নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে তারা।

মুহাম্মাদ সহ অনেক রোহিঙ্গা বলেছেন যে, তারা উভয় বাহিনীকেই কর দিতে বাধ্য হচ্ছেন। আরাকান আর্মি পূর্বে থেকেই রোহিঙ্গাদের প্রতি বিদ্বেষী ছিল। তবে রাজনৈতিক কৌশলের কারণে বর্তমানে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হয়েছে। আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদেরকে “বাঙালি” না বলে “মুসলিম” হিসেবে উল্লেখ করে। এটি রোহিঙ্গাদের জন্য আরও বেশি ক্ষতিকর। কারণ আরাকান আর্মি বৌদ্ধধর্মাবলম্বী হওয়ায় তাদেরকে মুসলিম হিসেবে উল্লেখ করলে সেটি রোহিঙ্গাদের বিদেশি বলেই ইঙ্গিত বহন করে। ফলে তাদের কাছে বর্তমানে রোহিঙ্গারা টিকে থাকলেও অদূর ভবিষ্যতে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়া অবাস্তব কিছু নয়।

আরাকান আর্মি যেসব এলাকায় নিয়ন্ত্রণ করছে এমন এলাকায় চলাচলের উপর মায়ানমার সামরিক বাহিনী কঠোর নিষেধাজ্ঞা কিছুটা শিথিল করেছে বলে জানা গেছে। রোহিঙ্গাদের ওপর সেনাবাহিনীর গণহত্যার কারণে জনমতের কিছুটা পরিবর্তনের লক্ষণ দেখা গেছে বলে গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হলেও, বাস্তবতা আগের মতোই রয়েছে বলে জানিয়েছেন রয়ে যাওয়া রোহিঙ্গারা। কেউ কেউ ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের প্রতি বৃহত্তর সংহতি না দেখানোর জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছে। রাখাইন রাজ্যের উত্তরে মংডুর কাছে রয়ে যাওয়া বসবাসকারী আব্দুল কাদের বলেন, “তারা মুখ থেকে বলছে, তাদের হৃদয় থেকে নয়।”

রাখাইন রাজ্যে সামরিক বাহিনীর নির্ধারিত কেম্পে বসবাস করছেন অন্তত ১,২০,০০০ রোহিঙ্গা। তারা জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক সামরিক বাহিনী ও আরাকান আর্মির যুদ্ধে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে অনেক বেশি। রোহিঙ্গারা কাজের জন্য ক্যাম্পের বাইরে যেতে পারছেনা। অন্যদিকে স্থানীয় মগ যুবকদের দ্বারা আক্রমণ ও ছিনতাইর ঘটনা বহুগুণ বেড়েছ। ৫০ কেজি চালের বস্তার দাম ইতিমধ্যে দ্বিগুণ হয়ে ৫০,০০০ কিয়াট হয়েছে। ক্যাম্পে বসবাসকারী একজন জানিয়েছেন, “আমি শুধু সকাল বেলায় খেয়েছি। তবে আমি অন্তত শাকসবজি হলেও সংগ্রহ করতে পেরেছি। কিন্তু এমন অনেক পরিবার রয়েছে যারা শাকসবজিও ব্যবস্থা করতে পারে না। ছোট বাচ্চারা সকাল থেকে বাড়িতে শুয়ে আছে, অনেক পরিবার তাদের বাচ্চাদের খাওয়াতেও পারেনি।”

এখানের কেম্পগুলো খুব সংকীর্ণ, বর্ষাকালে টিনের ছাদ ফুটো হয়ে বৃষ্টির পানি পড়ে। আর গরমে অসহ্য গরম পড়ে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, সামরিক অভ্যুত্থানের পর রোহিঙ্গা শিবির ও গ্রামে যে সাহায্য পাঠানো হয়েছে তা বন্ধ করে দিয়েছে সামরিক বাহিনী। এর ফলে সেখানে মানবিক সমস্যা আরও বেড়েছে।

লাখ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম আজ নিজেদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে উদ্বাস্তু হয়েছেন। দেশ-বিদেশ সবখানেই তারা আজ বন্দী জীবনযাপন করছেন। এতদসত্বেও আরাকানের রোহিঙ্গারা মুসলিম বলে কেউই তাদের দেশ উদ্ধারে এগিয়ে আসেনি। শুধুমাত্র মৌখক কিছু বিবৃতি আর মিথ্যা আশ্বাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে বিশ্ব সমাজ।

এব্যাপারে ইসলামি চিন্তাবীদদের বক্তব্য, এটি খ্রিস্টান অধ্যুষিত কোন অঞ্চল নয় যে, পশ্চিমা বিশ্ব মিলিটারি সাহায্য প্রেরণ করবে। রোহিঙ্গারা মুসলিম, তাই তাদের সাহায্য করার বিষয়ে কোন মাথাব্যাথা নেই কথিত সভ্য মানুষগুলোর। রোহিঙ্গা ইস্যুতে এটি স্পষ্ট যে, জাতিসংঘ বা কথিত বিশ্ব সম্প্রদায় কেউই মুসলিমদের জন্য সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসবে না।

কিছু বিশ্লেষণে এমন তথ্য উঠে এসেছে যে, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকাগুলোটে সামরিক বাহিনীর কোঠর বিধিনিষেধ থাকায়, খ্রিস্টান মিশনারি ও তাদের দোসর পশ্চিমা এনজিওগুলো সেখানে খ্রিস্টবাদ প্রচারের মিশন বাস্তবায়নে তেমন অগ্রগতি করতে পারছিল না। অপরদিকে চীন ও ভারতেরও সেখানে অর্থনৈতিক স্বার্থ ছিল। তাই সকল কথিত পরাশক্তির সম্মতিতেই রোহিঙ্গা উচ্ছেদাভিযান বাস্তবায়ন করা হয়েছে বলে মত অনেক বিশ্লেষকের।

এদিকে আবার বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের প্রতি মিডিয়া ও কথিত চেতনাধারী সুশীলরা নানান প্রোপ্যাগান্ডা ছড়িয়ে তাদের প্রতি জনমতকে খেপিয়ে তুলছে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে থাকা কিছু ডাকাত আর কুলাঙ্গারের কুকর্মের দায়ভার সকল অসহায় রোহিঙ্গার উপর চাপিয়ে দেওয়ার এই খেলা তারা শুরু করেছে মূলত ভারত ও পশ্চিমাদের প্রেসক্রিপশনে, এটাও দাবি করেছেন অনেকে। আর রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো ও ভাসানচরে সকল ইসলামি দলের প্রবেশ প্রায় বন্ধ করে দেওয়া, এবং সেখানে পশ্চিমা এনজিওগুলোকে সাহায্যের নামে খ্রিস্টবাদ প্রচারের মিশন বাস্তবায়নের সুযোগ করে দেওয়াটা কিসের আলামত- সেটাও আজ এক বিরাট প্রশ্ন। বাংলাদেশের সরকার ও প্রশাসন কি তাহলে ঐ এলাকায় পশ্চিমাদের খ্রিস্টান রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনার সামনে নতি স্বীকার করে নিয়েছে কি না – এই প্রশ্নও এখন বোদ্ধামহলে উচ্চারিত হচ্ছে।

এর চেয়ে বড় প্রশ্ন- মুসলিম উম্মাহ কি বাংলাদেশ ও অন্যান্য দেশে আশ্রয় নেওয়া এবং এখনো আরাকানে সামরিক বাহিনীর বন্দুকের নলের সামনে থেকে যাওয়া তাদের মুসলিম ভাইদের কথা ভুলে গেছে? বা তাদেরকে কি ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে? আর এই অঞ্চলে বিশ্ব পরাশক্তিগুলোর নানা রকম গেইমপ্ল্যানের কোন প্রভাব কি পুরো অঞ্চলে পরবে না? দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মুসলিমদেরকে এই বিষয়গুলো নিয়ে গভিরভাবে ভাবনা-চিন্তা করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞমহল।

স্বাভাবিকভাবেই এখন আরো যে প্রশ্নটির উদয় হয়, তা হলো- রোহিঙ্গা মুসলিমদের স্বাধীনতার জন্য এখন কী করনীয়? যেসব মুসলিমরা এতকাল কথিত গণতান্ত্রকে ক্ষমতা ও স্বাধীনতা লাভের মাধ্যম মনে করেছেন, তারা আরাকানসহ নির্যাতিত মুসলিম ভূখণ্ডগুলোর জন্য এখন তাদের মনভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করবেন কি না?

এজন্য হকপন্থী আলেমরা বলছেন, এখন সময় এসেছে হকের শিবির আর বাতিলের শিবির আলাদা হয়ে যাওয়ার; এই দুই-এর মাঝামাঝি কোন ‘ছাড় দেওয়ার’ রাস্তার অস্তিত্ব নেই- এটা এখন স্পষ্ট। সময় এসেছে মুসলিমদের ওপর চাপিয়ে দেয়া সকল তন্ত্র-মন্ত্র পরিহার করে বাস্তবতা অনুধাবন করার। এবং নববী আদর্শে ফিরে আশা ও মানহাজ অনুসরন করার মাধ্যমে রোহিঙ্গাসহ নির্যাতিত মুসলিমদ উম্মাহকে গৌরবময় সম্মানের আসনে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার। সেই সাথে সময় এসেছে বিশ্বমানবতাকে সত্যিকারের মুক্তির পথ দেখানোর; যে কারণে আল্লাহ তাআলা আমদেরকে শ্রেষ্ঠ উম্মত বানিয়েছেন- সেই দাবি পূরণ করার।



অনুবাদক ও সংকলক : মুহাম্মাদ ইব্রাহীম



তথ্যসূত্র :
1. Five years after the crackdown, Myanmar’s remaining Rohingya ‘living like animals’-
https://tinyurl.com/2p87v9yt

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

Website Powered by WordPress.com.

Up ↑

Design a site like this with WordPress.com
শুরু করুন