কুরআনের ভাষায় মিডিয়া যুদ্ধের কৌশল

কুরআনে সূরা বাক্বারার ২১৭ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ বলছেন,

“সম্মানিত মাস সম্পর্কে তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে যে, তাতে যুদ্ধ করা কেমন? বলে দাও এতে যুদ্ধ করা ভীষণ বড় পাপ। আর আল্লাহর পথে প্রতিবন্দ্বকতা সৃষ্টি করা এবং কুফরী করা, মসজিদে-হারামের পথে বাধা দেয়া এবং সেখানকার অধিবাসীদেরকে বহিস্কার করা, আল্লাহর নিকট তার চেয়েও বড় পাপ। আর ধর্মের ব্যাপারে ফেতনা সৃষ্টি করা নরহত্যা অপেক্ষাও মহা পাপ …”

হিজরী ২য় বর্ষে এই আয়াত নাযিল হয়। রাসূল (সাঃ) ‘আব্দুল্লাহ ইবনে জাহশ এর নেতৃত্বে ১২ জন সাহাবীকে কুরাইশদের একটি খাবারবাহী কাফেলার গতিরোধ করতে নাখলাহ (মক্কা ও তায়েফের মাঝামাঝি) নামক স্থানে প্রেরণ করেন। ‘আবদুল্লাহ ইবনে জাহশ যখন সেই কাফেলার কাছাকাছি গেলেন তখ্ন তারা সেখানে কিছু মুশরিকের দেখা পেল যারা মুসলিমদের উপর জুলুম-নির্যাতনে সবরকমের সীমা অতিক্রম করেছিল।

তারা মুসলিমদের অর্থসম্পদ আত্মসাৎ করেছিল, মুসলিমদের ঘরছাড়া করেছিল, সাহাবীদের অত্যাচার করত এবং রাসূল (সাঃ) কে ও তারা একাধিকবার হত্যার চেষ্টা করেছিল। মুসলিমদের মনে তখন এ কাফেলাটি আক্রমণ করে তাদের চুরিকৃত অর্থ্সম্পদের কিয়দাংশ ফেরত পাবার চিন্তা উদিত হয়, কিন্তু এ ধরণের অপারেশনের পথে বাধা ছিল সে সময়টি ছিল রযব মাস, যে মাসে যুদ্ধ বিগ্রহে লিপ্ত হওয়া ছিল হারাম। অনেকক্ষণ ভেবে দেখার পর, মুসলিমদের সেই ছোট্ট দলটি তাই করার সিদ্ধান্ত নেয় যা ইতিহাস এবং পরিস্থিতির বিচারে সমর্থনযোগ্য, তারা সে কাফেলাটি আক্রমণ করেন এবং তাদের হারানো কিছু সম্পদ পুনরুদ্ধার করেন।

এই ঘটনা রাসূল (সাঃ) কে অস্বস্তিকর পরিস্থিতে ফেলে দেয়। এই ঘটনাকে পুঁজি করে এবার মুশরিকরা সমাজে হৈ চৈ বাঁধিয়ে মুসলিমদের বিপক্ষে জনসমর্থন আদায়ের সুযোগ পায়। তারা বলে বেড়াতে থাকে মুসলিমরা যুদ্ধের ঐশ্বরিক রীতি লঙ্ঘন করেছে, তারা উগ্র, তারা জঙ্গী, তারা রক্তপিপাসু যুদ্ধবাজ; তারা শান্তি ও স্বাধীনতা বিরোধী চক্র এবং এ ধরণের নানান কথা। এক পর্যায়ে গিয়ে ইবন জাহশ ও তার বাহিনী কর্তৃক কাফেলা আক্রমণের ঘটনায় মুসলিমরা ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া ব্যাক্ত করে।

অবশেষে, আল্লাহ এই আয়াতটি নাযিল করেন এবং নিশ্চিত করেন, হ্যাঁ, নিষিদ্ধ মাসে যুদ্ধ করার নিষিদ্ধ, তবে, তার থেকেও নিকৃষ্ট হল মক্কার মুশরিকরা মুসলিমদের সাথে এতদিন ধরে যা কিছু অন্যায় করে আসছে। এবং এর মাধ্যমে মুসলিমদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগকে কেন্দ্র করে কুরাইশদের যে শোরগোল তাকে নিস্ফল হয়ে যায়।

বর্তমানকালেও এই ধরণের পরিস্থিতি কিভাবে মোকাবেলা করতে হবে সে ব্যাপারে এই আয়াত আমাদেরকে শিক্ষা দেয়। এই শিক্ষা হল, ইসলামের শত্রুরা কিছু ঘটনাকে পুঁজি করে ফায়দা লুটবার চেষ্টা করে যা আমাদেরকে রক্ষণাত্মক অবস্থানে ঠেলে দেয়। কিন্তু আমাদের উচিত রক্ষণাত্মক না হয়ে ও কৈফিয়ত দেয়ার চেষ্টা না করে বরং তাদেরকে তাদের অপরাধের জন্য আক্রমণ করা।

ইবনে জাহশের অনুচিত কাজটিকে তারা শঠতাপূর্ণ উপায়ে এমন ঢাক-ঢোল পিটিয়ে সবার সামনে তুলে ধরেছে, যে তাদের নিজেদের সব অপকর্ম এর নীচে চাপা পড়ে গেছে, যেখানে কিনা তাদের অন্যায় ও অপকর্মই এই ঘটনার মূল প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। তাদের এই উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণার জবাবে আল্লাহ মুসলিমদেরকে রক্ষণাত্মক হতে বলেননি, তাদের সামনে কৈফিয়ত পেশ করতে বলেননি, বরং আল্লাহ মুসলিমদেরকে আদেশ করেছেন তারা যা কিছু অপকর্ম করেছে তা তাদের সামনে তুলে ধরতে। এখানে মুসলিমদের আচরণটা হবে এমন-

“এক্সকিউজ মি? তুমি কাকে তুমি সন্ত্রাসী, উগ্রপন্থী বলছ? তুমি নিজে কি করে এসেছে আমাদের সাথে, সে ইতিহাসের দিকে আগে লক্ষ্য কর!”

এই যমানায় এসেও মুসলিমদেরকে এই ধরণের পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। যখনই আমাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদ, উগ্রপন্থা এবং এই ধরণের আরো অতি পরিচিত কিছু অভিযোগের সামনে তাক করা হয়, তখন অধিকাংশ মুসলিম, তাদের নিয়তও হয়তো ভাল, তারা রক্ষণাত্মক অবস্থান নিয়ে নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করতে ব্যাতিব্যস্ত হয়,

“দেখুন অল্প কিছু মানুষের কাজের জন্য আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হতে দেওয়া যায় না”, “আমরা শান্তিকামী মুসলমান”, “ইসলাম নিরীহ মানুষ হত্যা কোনক্রমেই সমর্থন করে না”, ইত্যাদি। হতে পারে তারা এসবের সাথে মোটেও জড়িত ছিল না, কিন্তু আগ-বাড়িয়ে এসব কথা বলে নিজেদের ইমেজ ক্লিন রাখার চেষ্টা পরাজিত মানসিকতার একটি লক্ষণ, যা পশ্চিমা মুসলিমদের একটি সনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য।

পশ্চিমারা এভাবে আমাদের জন্য ফাঁদ পেতে রেখেছে, তারা চায় আমরা নমনীয় হই, কৈফিয়ত ও আত্মরক্ষাসুলভ প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করি, এর মাধ্যমে তারা চায় নিজেদের হাতে গড়া হিংস্র ও রক্তাক্ত ইতিহাস আড়াল করতে। এ কারণেই, এই আয়াতটি আমাদের শিক্ষা দেয়, কাফিরদের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে নমঃনমঃ হয়ে নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করার এই বেদনাদায়ক মানসিকতা যেন আমরা পরিত্যাগ করি, বরং তাদেরকে তাদের অপকীর্তির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাদেরকে ঘায়েল করি। আর তাদের অপকীর্তির উদাহারণ ভুরি ভুরি।

যেমন করে এই আয়াতে মুসলিমদের শিক্ষা দেওয়া হয়েছে কুরাইশদের অপকর্ম ও অন্যায়ের স্বরুপ উন্মোচন করতে যাতে করে তাদের গর্জন স্তিমিত করে দেওয়া যায়, তেমনি আমাদের উচিত, আজকে যারা ইসলামের শত্রু, তাদের সীমাঙ্ঘন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়া এবং সেগুলোর একটি তালিকা তৈরি করা, এবং যখনই তারা আমাদেরকে বিরুদ্ধে সন্ত্রাস বা উগ্রপন্থার অভিযোগ তুলে আঙুল তাক করার ধৃষ্টতা দেখাবে এবং নিজেদের পরম হিতৈষী শান্তিকামী হিসেবে দাবি করবে, তখন আমরা তাদের কুকীর্তির ইতিহাস উন্মোচন করব।

আমাদের নেটিভ আমেরিকানদের গণহত্যার ইতিহাস সম্বন্ধে জানা উচিত। কলম্বাস আসার পূর্বে তাদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১ কোটি, কিন্তু ইউরোপিয়ান হানাদাররা বর্তমান আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের এই আদি অধিবাসীদের কচুকাটা করে তাদের সংখ্যা নামিয়ে আসে ১ কোটি থেকে ১০ লক্ষেরও নীচে।

আফ্রিকার দাসদের ইতিহাস নিয়ে আমাদের পড়াশোনা করা উচিত। সেখানে ৫০ মিলিয়ন মানুষ তাদের জীবন দিয়েছে দাস-বণিক ও উপনিবেশ স্থাপনকারীদের হাতে। এটি সুদূর ইতিহাসের ঘটনা নয়, এটি ঘটেছিল সেই যুগে, যে যুগকে আধুনিক পশ্চিমা সভ্যতার সূচনাকাল হিসেবে ধরা হয়। কোন দেশ ছিল এই নিষ্ঠুরতার পেছনে? পশ্চিমা ইউরোপ এবং আমেরিকা, যাদের কিনা সবচেয়ে “সভ্য” জাতি হিসেবে গণ্য করা হয়।

আমাদের মেক্সিকান-আমেরিকান যুদ্ধের ইতিহাস জানা উচিত, এবং “manifest destiny” এর অর্থ জানা উচিত। (manifest destiny হল এই নিয়তিতে বিশ্বাস করা যে, আমেরিকান সৈন্যরা বিশ্বের সকল প্রান্তে ছড়িয়ে পড়বে, বস্তুত এই প্রোপাগান্ডার উদ্দেশ্য ছিল মানুষের মনে “আমেরিকা অপরাজেয়”-এমন একটি ধারণা জন্ম দেওয়া)।

১৯ শতকের শেষদিকে আমেরিকান দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে ফিলিপিনোদের বিদ্রোহের কাহিনী সম্পর্কে আমাদের জানতে হবে। আমাদের জ্ঞানের পরিধিতে অন্তর্ভূক্ত করতে হবে হিরোশিমা ও নাগাসাকির পারমাণবিক বিস্ফোরণের ঘটনা। প্রায় দেড় লক্ষ মানুষ মুহুর্তের মাঝে ছাই হয়ে যায় এই বোমার কবলে পড়ে। এদের সবাই ছিল বেসামরিক লোক, তারা যে যার মত কাজ করছিল। ইতিহাসে এক জাতি কর্তৃক অপর জাতির উপর পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের এটিই একমাত্র ঘটনা, এবং নির্মম বাস্তবতা এই, যারা সেইদিন নিজেরা পারমাণবিক বোমা ফাটিয়েছিল, তারাই আজকে হর্তা-কর্তা সেজে বিশ্বব্যাপী লেকচার দিয়ে বেড়ায় যার-তার হাতে যেন এই পারমাণবিক বোমা চলে না যায়। (দেখুন, John Hersey র “হিরোশিমা”)

ল্যাটিন আমেরিকা, বিশেষ করে এল সালভাদর, চিলি, পানামা, নিকারাগুয়া, হন্ডুরাস, গ্রেনেডা এবং গুয়েতমালায় আমেরিকা যুক্তরাষ্টের হস্তক্ষেপ করার ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান থাকা উচিত। হাওয়ার্ড যিন এর বইগুলো সেক্ষেত্রে ভালো কাজ দিতে পারে।

আমাদের ১৯৯০ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধের ইতিহাস এবং তৎপরবর্তী আমেরিকা-নেতৃত্বাধীন জাতিসংঘ কর্তৃক ইরাকের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করার ইতিহাস জানতে হবে। এই অবরোধের মাধ্যমে ইরাকে খাদ্য-পানি-ঔষধ্পত্র সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। শিশুদেরকে অনাহারে এবং ঔষধসেবা থেকে বিরত রাখা ছিল যুদ্ধেরই একটি কৌশল। ১৯৯৬ সালে, “60 Minitues” নামের একটি অনুষ্ঠানে, ম্যাডেলিন অলব্রাইট (আমেরিকার প্রথম মহিলা সেক্রেটারি অফ স্টেট), আমেরিকার পক্ষ থেকে নিশ্চিত করেন যে তারা মনে করেন, ইরাকে ৫ লক্ষ শিশুর মৃত্যু তাদের যথার্থ পাওনা

১৯৯৩ সালে আমেরিকা কর্তৃক সোমালিয়া আক্রমণের ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের অধ্যয়ন করতে হবে, যেখানে প্রায় ২০০ সোমালিকে তারা হত্যা করেছিল।

আমেরিকা কর্তৃক ইসরাইলকে সাহায্য-সহযোগিতা প্রদানের ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের খুঁটিনাটি জানতে হবে, তাদের এই সহায়তার স্বরুপ প্রকাশ পেয়েছে প্রতিটি বুলেট, মিসাইল, বুলডোজার এবং যুদ্ধবিমানে, যেগুলো দিয়ে ফিলিস্তিনের প্রতিনিয়ত আমাদের ভাই-বোনদের হত্যা করা হয়। (নরম্যান ফিনকেলস্টিনের বইগুলো পড়ুন)

আমাদের জানতে চাওয়া উচিত, কীভাবে তারা আমাদেরকে সন্ত্রাসী ডাকার স্পর্ধা দেখায় যখন তারা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে আমাদের দু-দুটো দেশে আগ্রাসন চালিয়েছে, জবরদখল করেছে, করছে এবং বম্বিং করেছে।

মনোবিজ্ঞানের একটি ধারণা আছে, যাকে বলা হয় psychological projection। এই ধারণামতে, যখন কেউ কোন অপকর্মের দায়ে দোষী, সে নিজের বিবেকের দংশন থেকে মুক্তি পেতে নিজের উপর থেকে সকলের মনযোগ সরিয়ে নিতে চায় এবং অন্য কারো কাঁধে নিজের দোষ চাপিয়ে বাঁচতে চায়। আজকের দিনে আমাদের শত্রুদের সম্ভবত এই রোগেই ধরেছে। যাই কিছু হোক, আল্লাহ আমাদেরকে এই আয়াতে শিখিয়ে দিয়েছেন কিভাবে আমরা তাদের অপপ্রচারে জবাব দেব (এবং কিভাবে দেব না)।


মূলঃ

طارق مهنا
তারিক মেহান্না
প্লাইমাউথ কারেকশনাল ফ্যাসিলিটি
আইসোলেশন ইউনিট – সেল #১০৮
জুন ১৮, সকাল ৯টা ২২ মিনিট।

মূল লেখাটি ইংরেজিতে, অনুবাদকের নাম জানা যায় নি। আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা তাদের উভয়কে উত্তম প্রতিদান দান করুন।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

Website Powered by WordPress.com.

Up ↑

Design a site like this with WordPress.com
শুরু করুন