প্রশ্ন: কিতালের পূর্বে কাফেরদেরকে দাওয়াত দেয়ার কি বিধান? দাওয়াতের প্রকার ও হিকমতসহ আলোচনা করুন?
উত্তর: কাফেরদের অবস্থাভেদে কিতালের পূর্বে তাদেরকে দাওয়াত দেয়ার বিধান ভিন্ন ভিন্ন হয়। কখনো দাওয়াত দেওয়া ফরয, কখনো মুস্তাহাব আবার কখনো দাওয়াত দেয়া নাজায়েয।
ইকদামি জিহাদের সময় যদি কাফেরদের কাছে ইসলামের দাওয়াত না পৌঁছে, তাহলে আক্রমণ করার পূর্বে তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেয়া আবশ্যক। দাওয়াত ব্যতীত আক্রমণ করা জায়েয নয়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
“তুমি নিজ প্রতিপালকের পথে মানুষকে ডাকবে হিকমত ও *উত্তম উপদেশের মাধ্যমে।” -সূরা নাহল: ১২৫
আল্লাহ তাআলা আরো বলেন,
“রাসূল পাঠানো (এবং রাসূলের মাধ্যমে দাওয়াত পৌঁছানো ও সতর্ক করণ) ব্যতীত আমি (কোন জাতিকে) শাস্তি দেই না।” -সূরা ইসরা: ১৫
মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত,
“হযরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাওয়াত না দিয়ে কোন কওমের উপর আক্রমন করেননি।” –মুসনাদে আহমদ, হাদিস ২০৫৩
সহীহ মুসলিম শরীফে এসেছে:
“হযরত সুলাইমান ইবনে বুরাইদা রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি তার পিতা – বুরাইদা রাদি. – থেকে বর্ণনা করেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন কাউকে কোন জাইশ-বড় বাহিনী বা সারিয়্যা-ছোট দলের আমীর নিযুক্ত করতেন … তখন তাকে বলে দিতেন, আল্লাহর রাস্তায় আল্লাহর নামে ঐসব লোকের বিরুদ্ধে কিতাল করবে, যারা আল্লাহর সাথে কুফরী করেছে। … যখন তুমি তোমার দুশমন মুশরিকদের মুকাবেলায় যাবে, তখন তাদেরকে তিনটি জিনিসের আহ্বান জানাবে; এর যে কোন একটায় তারা সম্মত হলে তুমি তাদের থেকে তা গ্রহণ করবে এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা পরিত্যাগ করবে:
(প্রথমত) তাদেরকে মুসলমান হয়ে যাওয়ার আহ্বান জানাবে। যদি তারা তাতে সম্মত হয়ে যায়, তাহলে তাদের থেকে তা গ্রহণ করে নেবে এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিত্যাগ করবে।
যদি তারা এতে অসম্মতি জানায় তাহলে জিযিয়ার আহ্বান জানাবে। যদি তারা তাতে সম্মত হয়ে যায়, তাহলে তাদের থেকে তা গ্রহণ করে নেবে এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিত্যাগ করবে।
যদি তারা এতেও অসম্মতি জানায়, তাহলে আল্লাহ তাআলার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হবে।”- সহীহ মুসলিম ১৭৩১
দাওয়াতের হিকমত
ইসলামের দাওয়াত পৌঁছার আগেই আক্রমণ করে বসলে তারা বুঝে উঠতে পারবে না যে, আমরা কেন যুদ্ধ করছি? ধনসম্পদ লুট করার জন্য না’কি দ্বীনের জন্য? দাওয়াত দিয়ে স্পষ্ট করে দিতে হবে যে, আমাদের যুদ্ধ দ্বীনে হক তথা ইসলামের প্রচার-প্রসারের জন্য। তখন হয়তো তারা ইসলাম গ্রহণ করে তার সুশীত ছায়াতলে আশ্রয় নিতে পারে, কিংবা জিযিয়া দিয়ে ইসলামী হুকুমতের অধীনস্ততা বরণ করে নিতে সম্মত হতে পারে। কোনটাতেই সম্মত না হলে তাদের আর কোন উজর বাকি নেই। এবার তরবারিই তাদের সমাধান।
পক্ষান্তরে যাদের কাছে দাওয়াত পৌঁছে গেছে, তাদেরকে দ্বিতীয়বার দাওয়াত দেয়া আবশ্যক নয়। দাওয়াত ছাড়াই আক্রমণ বৈধ। সহীহ বুখারীতে আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত হয়েছে,
“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু মুস্তালিকের উপর আকস্মিক আক্রমন করলেন। তখন তারা অপ্রস্তুত ও বেখবর ছিল। তাদের গবাদিপশুগুলো পানি পান করছিল। তিনি তাদের যোদ্ধোপোযোগী পুরুষদের হত্যা করলেন। তাদের নারী-শিশুদের বন্দি করলেন। আর ঐ যুদ্ধেই তিনি উম্মুল মুমিনীন জুওয়াইরিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহাকে গনিমত হিসেবে পেয়েছিলেন।” -সহীহ বুখারী ২৫৪১
হাফেয ইবনে হাজার রহ. (৮৫২হি.) সহীহ বুখারীর ভাষ্যগ্রন্থ ফাতহুল বারীতে বলেন,
“অধিকাংশ আলেমদের মতে দাওয়াত দেওয়ার আবশ্যকতা ইসলামের সূচনালগ্নে ছিল, যখন ইসলামের দাওয়াত ব্যাপকভাবে প্রচার হয়নি। (আর এখন যেহেতু ইসলামের দাওয়াত ব্যাপকভাবে প্রচার হয়েছে, সকলেই ইসলামের কথা জানে, তাই এখন দাওয়াত দেওয়া জরুরী নয়।) তবে যদি এমন কেউ থেকে থাকে, যাদের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছেনি, তাহলে দাওয়াত দেওয়ার পূর্বে তাদের সাথে যুদ্ধ করা যাবে না। … সাঈদ বিন মানসুর রহ. (তার সুনানগ্রন্থে) বিখ্যাত তাবেয়ী আবু উসমান নাহদি রহ. থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, ‘আমরা কোনো কোনো সময় দাওয়াত দিতাম, আবার কোনো কোনো সময় দিতাম না’। আমি বলি- অর্থাৎ হাফেয ইবনে হাজার রহ. বলেন- হাদিসটি দুই সময়ে পূর্ব বর্ণিত ভিন্ন দুই অবস্থার উপর প্রয়োগ হবে।” -ফাতহুল বারী ৬/১০৮
অর্থাৎ যাদের কাছে দাওয়াত পৌঁছেছে তাদের সাথে দাওয়াত ব্যতীতই যুদ্ধ করতেন, আর যাদের কাছে পৌঁছেনি তাদেরকে দাওয়াত দিয়ে নিতেন।
যাদের কাছে দাওয়াত পৌঁছেছে, তাদেরকে পুনর্বার দাওয়াত দিলে যদি ফায়েদা হবে বলে আশা থাকে- যেমন, তারা হয়তো মুসলমান হয়ে যাবে বা জিযিয়ায় সম্মত হবে বলে আশা করা যায়- তাহলে দ্বিতীয়বার দাওয়াত দেয়া মুস্তাহাব। খায়বারের যুদ্ধ যে ইয়াহুদীর সাথে চলছিল, তারা ইসলাম সম্পর্কে সম্যক অবগত ছিল। তথাপি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন আলী রাযিআল্লাহু আনহুকে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাঠান, তাকে অসিয়ত করে দেন,
“ধীর-স্থিরভাবে গিয়ে তাদের প্রাঙ্গণে অবতরণ করবে। এরপর তাদেরকে ইসলামের দিকে আহ্বান করবে এবং তাদের উপর আল্লাহ তায়ালার যে হক রয়েছে তার ব্যাপারে তাদেরকে অবগত করবে। আল্লাহর শপথ! তোমার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা একটি মাত্র লোককে হিদায়াত দিলেও তা তোমার জন্য লাল উটের চেয়ে উত্তম।” -সহীহ বোখারী ৩৭০১
যদি ফায়েদা হবে বলে কোন আশা না থাকে, তাহলে পুনর্বার দাওয়াত মুস্তাহাব নয়।
পক্ষান্তরে যদি দাওয়াত দিতে গেলে ক্ষতির আশঙ্কা থাকে- যেমন, তারা দূর্গে আশ্রয় নিয়ে নেবে ফলে সহজে কাবু করা সম্ভব হবে না বা মুসলমানদের ব্যাপারে কোন ষড়যন্ত্র পাকাবে- তাহলে দাওয়াত দেয়া নাজায়েয।
তদ্রূপ যদি তারা আমাদের উপর আক্রমণ করে বসে তাহলেও দাওয়াতের কোন বিধান নেই।
মূলঃ আহকামুস সিয়ার ভাই
এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান